‘আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বাস করতে চাই’

3
16

নিজস্ব প্রতিবেদক

নড়াইল শহর সংলগ্ন আউড়িয়া ইউনিয়নের বিরোধপূর্ণ দুটি গ্রাম শড়াতলা ও রামচন্দ্রপুর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে দীর্ঘদিন ঘটে চলেছে রক্তপাতের ঘটনা। হামলা-পাল্টা হামলা, মামলা-পাল্টা মামলায় জর্জড়িত দুটি গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষই আসামি। নড়াইলের আদালতে দুটি পক্ষের ৯টি মামলা চলমান। এই দুটি গ্রামের ৮২ জনের নামে থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। রাতে পুলিশের ভয়ে ঘুমাতো হয় অন্যগ্রামে অথবা বাগানে।

২০১১ সাল থেকে চলে আসা বিরোধ গত চার বছর ধরে সংঘাত বেড়ে যায়। গত এক বছরে দু’পক্ষের হামলা-পাল্টা হামলায় এখন অন্তত ৪ জন পঙ্গুত্ববরণ করেছে। অসংখ্য মানুষ শরীরে একাধিক আঘাতে চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন।

দুটি গ্রামের এই বিরোধের বিষয়টি নড়াইলের পুলিশ সুপার উদ্যোগ নেন। দুটি পক্ষের মাতব্বরদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে শুক্রবার উভয়পক্ষের লোকজন নিয়ে মীমাংসায় বসেন। বিকেলে আউড়িয়া ইউনিয়নের বাদশার গ্যারেজ সংলগ্ন একটি ধানের চাতালে মীমাংসার জন্য উভয়পক্ষ উপস্থিত হন।

মীমাংসার এই বৈঠকে উপস্থিত হন নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন বিশ্বাস, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. শরফুদ্দিন, সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইলিয়াস হোসেন, চন্ডিবরপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভূঁইয়া, আউড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. পলাশ মোল্যা, আউড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ. রহমান চৌধুরীসহ অনেকে।

উভয়পক্ষের মাতবরদের বক্তব্য শেষে বিরোধ মীমাংসার সিদ্ধান্ত নেন গ্রামবাসী। উপস্থিত অতিথিবৃন্দ উভয়পক্ষের মাতবরদের হাতে হাত ধরিয়ে দেন। আর কোনো মারামারি করবে না বলেও দু’পক্ষের লোকজন ওয়াদাবদ্ধ হন।

বক্তব্যকালে এক পক্ষের মাতবর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার বিমানবাহিনীতে ক্লার্ক পদে চাকরি হয়েছিলো। চাকরিতে যোগদানের জন্য রওয়ানা হলে ২০১৭ সালের ৪ মার্চ প্রতিপক্ষের লোকজন আমাকে বেপরোয়াভাবে মারধর করে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। আমি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করি। তিন মাসেও সুস্থ হতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি। এই দ্বন্দ্বের কারণে দলের কয়েকজন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। আমরা আর বিরোধ চাই না।’

অপরপক্ষের মাতবর রবি মোল্যা বলেন, ‘আমার শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমার দলের কয়েকজন পঙ্গু হয়ে বসে আছে। মামলা-মোকদ্দমাসহ প্রতিপক্ষের হামলার আতঙ্ক নিয়েই চলাফেরা করতে হয়। অন্যান্য এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে, আর আমরা মারামারি করে সবদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা মনের থেকে সকল বিভেদ ভুলে মিলে-মিশে বাস করতে চাই।’

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, নড়াইল জেলার বদলী হওয়ার পর জানতে পারি এই জেলায় গ্রাম্য কোন্দল বেশি হয়। আমি যোগদানের পর অনেক এলাকার বিরোধ মীমাংসা করে দিয়েছি। আশা করি শড়াতলা ও রামচন্দ্রপুর গ্রামবাসী দীর্ঘদিনের বিরোধ নিরসনের মধ্যদিয়ে আগামী দিনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। এরপর থেকে বিশৃঙ্খলা ঘটলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে। নড়াইলের সব এলাকার মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হবে।’

বিরোধ নিরসণ চলাকালে সম্প্রতি প্রতিপক্ষের হামলায় পঙ্গুত্ববরণকারী একলাচ ফকির ও দিনার ফকির ভ্যানের ওপর শুয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে তাদের চোখে ও মুখে ছিল কষ্টের ছাপ।

পঙ্গুত্ববরণকারী একলাচ ফকির ও দিনার ফকির বলেন, আমাদের মতো আর কারও যেন এমন অবস্থা না হয়। আমরা আর কোনো হানাহানি চাই না। আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বাস করতে চাই।’