ক্যাপাসিটি চার্জ কী বোঝা, নাকি সক্ষমতার ভিত্তি?

0
8
ক্যাপাসিটি চার্জ কী বোঝা, নাকি সক্ষমতার ভিত্তি?
ক্যাপাসিটি চার্জ কী বোঝা, নাকি সক্ষমতার ভিত্তি?

ডেস্ক রিপোর্ট

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংসদে বিদ্যুৎ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপন করেন। তাতে দেখা যায় বর্তমান সরকার তিন মেয়াদের ১৪ বছরে কুইক রেন্টালের ভাড়া এবং ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এনিয়ে দেশের দুই গণমাধ্যমে যে ভাবে সংবাদ ছেপেছে তাতে মনে হচ্ছে সরকারী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসে থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় করেছে সরকার। তথ্যের খেলায় পাঠকদের বিশেষ দিকে ধাবিত করার অপচেষ্টা।

কিছু গণমাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন মঙ্গলবার সংসদে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সেই তথ্য দিয়ে বুধবার প্রথম আলো প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশ করেছে। শিরোনাম দেওয়া হয়েছে- “বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া কারা কতো পেলো”। আর ডেইলি স্টারের শিরোনাম ”ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা, চিন্তার চেয়েও বেশি। এছাড়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সংসদে উপস্থাপিত তথ্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেনো প্রাইভেট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিচ্ছে সরকার। কেন কুইক রেন্টালগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিচ্ছে এই নিয়ে কোথাও কোন ব্যাখা বা তথ্য দেয়া হয়নি।

কুইক রেন্টাল কেন এলো
৩০ বছর আগেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানি হিসাবে বিবেচনা করা হতো তেল আর গ্যাসকে। তার আগে হতো জলবিদ্যুৎ। ২০০০ সালের আগে পরে তেলের দাম কম থাকতে তেল নির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে ইনভেস্টমেন্ট করতে শুরু করে বড় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো। তখন ১/২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ সমৃদ্ধ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যুৎকেন্দ্র করবার সক্ষমতা ছিল না। আর ২০০৯ সালে ৩২৬৮ মেগাওয়াট সক্ষমতা নিয়ে দেশে প্রয়োজন ছিল চটজলদি বিদ্যুৎ আর সঞ্চালন লাইন, সাবস্টেশন নির্মাণসহ ভবিষ্যতের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা। দিনে ১৫/১৬ ঘণ্টার লোডশেডিং ও বিদ্যুতের কারণে শিল্পের উৎপাদন হ্রাস থেকে চটজলদি বিদ্যুৎ এর জন্য কুইক রেন্টালের কোন বিকল্প ছিল না সেই সময়ে।

ক্যাপাসিটি চার্জ কী
প্রাইভেট কুইক রেন্টাল থেকে সরকার নগদ টাকায় বিদ্যুৎ কিনে নেয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। কিন্তু প্রাইভেট এই ইনভেস্টরদের ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন এর কথাটা মাথায় রাখা আবশ্যক ছিল। কেউ ১/২ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করে একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে, এখন সরকারের যদি বিদ্যুতের অল্টারনেটিভ সোর্স তৈরি হয়ে যায় আর বিদ্যুৎ না কেনে ওই সকল কেন্দ্র থেকে তাহলে কি হবে? এতো ইনভেস্টমেন্ট তো মাঠে মারা যাবে। তখন আসে ক্যাপাসিটি চার্জ বিষয়টা।

মানে সরকার যদি বিদ্যুৎ নাও কেনে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মিনিমাম একটা এমাউন্ট ওই বিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিতে হবে, যতদিন সেই প্রকল্পে বিনিয়োগকৃত মূলধন, খরচ আর লাভ উঠে না আসে। কোন কোন বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে এর সময়টা ১৫ থেকে ২৫ বছরের একটা চুক্তি। আবার প্রাথমিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও যদি সরকারের বিদ্যুৎ প্রয়োজন থাকে তাহলে ৩/৪ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করতে পারবে।

আপনি হলে কী করতেন
একটা বিশেষ পণ্যের ব্যবসা শুরু করলেন যেটা শুধু সরকার কিনতে পারবে। সেই পণ্য উৎপাদনের জন্য আপনি ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে কারখানা বানালেন। এখন দুই বছর পরে হুট্ করে যদি সরকার বলে তারা আপনার কাছ থেকে আর পণ্য কিনবে না কারণ আরেকটা কারখানা থেকে তারা আও সহজেই পণ্য কিনতে পারছে, তখন আপনি কি করবেন? আপনি অবশ্যই আপনার লাভসহ বিনিয়োগ উঠে আসার নিশ্চয়তা চাইবেন, এই নিশ্চয়তা থেকেই এসেছে ক্যাপাসিটি চার্জ বিষয়টা। অর্থাৎ চুক্তির নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যদি সেই সকল কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ না কেনে, তাহলে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট একটা চার্জ দিতে হবে কুইক রেন্টালগুলোকে, যেটা “ক্যাপাসিটি চার্জ” হিসাবে পরিচিত।

ক্যাপাসিটি চার্জ কেন নিরাপদ সিদ্ধান্ত
২০১৪/১৫ থেকে সম্ভবত সরকার কয়লা বিদ্যুতের দিকে গেছে, যেখানে সরকার নিজেই বিনিয়োগ করে বা সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে, বা যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে। এখন এই সকল কয়লা আর এলএনজি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনলে বেশি দাম দিয়ে তেল নির্ভর প্রাইভেট প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রয়োজন নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তেল ভিত্তিক ভাড়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনাটা অনেক দাম পরে যাচ্ছে, কারণ ২০০০ সালে যেই তেলের দাম ছিল ১২ টাকা লিটার, বর্তমানে সেই তেলের দাম ১০৯ টাকা লিটার। তাই বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনলে সরকারের যা খরচ হবে, তারচেয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে দিলে খরচ কম হবে, এই চিন্তা থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে দেয়াটাই নিরাপদ সিন্ধান্ত।

বর্তমানে ১০২ টি বেসরকারি বিদ্যুতকেন্দ্রের মধ্যে ৮টি কুইক রেন্টালের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সরকার চুক্তি নবায়ন করেনি। কারণ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে, সরকারের আর প্রয়োজন নেই সেই সকল কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার। কিছু কুইক রেন্টাল থেকে চুক্তির বাধ্যবাধকাতার কারণে বিদ্যুৎ এখনও কিনতে হচ্ছে সরকারকে, বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। কারণ বর্তমানে মোট প্রয়োজনের মাত্র ৪৪ শতাংশ সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন করতে পারছে। এখনও ৪৩ শতাংশ বিদ্যুতের জন্য বেসরকারি রেন্টালের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে।

এখন ২০২৩ এ বসে সেই চুক্তি আর ক্যাপাসিটি চার্জকে অনর্থক মনে হতেই পারে। কিন্তু ৯৬/৯৭/৯৮ সালে ওই প্রাইভেট কোম্পানির শর্তে রাজি না হলে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদনই সম্ভব হতো না তখন। শিল্পের উৎপাদন আর লোডশেডিং থেকে নিস্তারের জন্য বসে থাকতে হতো আরও ৭/৮ বছর।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গত ১৪ বছরে সরকারি বিনিয়োগে বিদ্যুতের বড় বড় প্রকল্পের সাথে সাথে সরকার বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন বাড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বেড়েছে আধুনিক টেকনোলজি সম্পন্ন সাবস্টেশনের সংখ্যা। বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ।