আমার স্মৃতিতে লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ

0
25
সরকারি সহায়তায় আর্থসামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছেন বীরমুক্তিযোদ্ধারা
মুক্তিযোদ্ধা (প্রতীকী ছবি)

আবদুস ছালাম খান

১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভের বছর। বিশ্বের সর্বাধিক রক্ত ও প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে স্বাধীনতা লাভের এই মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাসের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের মানুষ যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও মানবেতর জীবন কাটিয়েছে তা মানব ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। আর তাইতো মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা এই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তারা যে বয়সেরই হোক না কেন কম-বেশি অনুভব করেছে স্বাধীনতা লাভের জন্য এদেশের মানুষকে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। সে সময়ে মায়ের পেটে থাকলেও পরোক্ষ ভাবেও কত কষ্টই না স্বীকার করতে হয়েছে।

পাক হানাদার বাহিনীর সে নির্মম অত্যাচার- নির্যাতনের বিবরণ কাগজে লিখে বোঝানো যাবে না। বাংলাদেশের এমন কোন জনপদ ছিল না যেখানে তাদের হিংস্রতা থেকে রেহাই পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভের আনন্দে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার কথা সে সময়ে এক অর্থে এ দেশের মানুষ সাময়িকভাবে ভুলেই গিয়েছিল। তবে তাদের সে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। বাংলাদেশের মানুষ কোন দিন ওদের ক্ষমা করতে পারে না। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য সে দুঃসময়ে সামান্য হলেও আমার স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। অপরদিকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মলাভের সেই শুভ সময়টা স্বচক্ষে দেখেছি এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের বলে আমি মনে করি। একই সাথে আমি এই সৌভাগ্যের জন্য গর্ববোধ করতেই পারি। কারণ যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে।

কিন্তু কেউ আর কোন দিন ইচ্ছা করলেও স্বাধীনতা যুদ্ধ স্বচক্ষে দেখতে বা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে পারবে না। তাই আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সে দিনগুলি পরবর্তী বংশধরদের জানার জন্য ছাপার অক্ষরে লিপিবব্ধ করে রাখার প্রয়াসে ‘আমার স্মৃতিতে লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি সবেমাত্র ১০ম শ্রেণির ছাত্র। বয়স কতই বা হবে-পনের কি ষোল বৎসর হবে। ডিজিটাল যুগের ওই বয়সের একজন ছাত্রের চেয়ে সঙ্গত কারণেই সে যুগের একজন ছাত্র অপেক্ষকৃত কম চটপটে ছিল। তবুও সে সময়ে আমার সহপাঠিরা অনেকেই বয়স এবং সাইজে আমার চেয়ে বড় হওয়ায় শসস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। অবশ্য কোথাও কোথাও একই কারণে আমার নীচের শ্রেণির ছাত্ররাও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল। তবে আমি ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শসস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা না হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এই গৌরবজনক মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনকারী বটে।

মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত অনেকের মত আমার নামও তালিকাভুক্ত হওয়া উচিৎ ছিল। মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তিকালে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ’ হিসাবে আরেকটি তালিকা থাকা উচিৎ। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান সজ্ঞানুযায়ী এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সংজ্ঞানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তবে যারা এই যুদ্ধে কোন ভুমিকা না রেখেই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদের কথা ভিন্ন। তাদের ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।

মুক্তিযুদ্ধকালের পুরো সময়টা আমি লোহাগড়া থানার কুন্দশী গ্রামে আমার পৈত্রিক নিবাসে অবস্থান করেছি। গ্রামটি থানা সদরের অতি নিকটবর্তী হওয়ায় লোহাগড়ায় মুক্তিযুদ্ধকালের অনেক ঘটনাই আমার স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছে। কিছু ঘটনা স্বচক্ষে না দেখলেও সে সময়ে এমনভাবে জেনেছি যেন সেটা আমার দেখা বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৫০ বৎসর পর আমার দেখা বা জানা সে সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি লিখতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি বা অনেকের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বাদ পড়ে যেতে পারে। তবে তা ইচ্ছাকৃতভাবে হবে না। তাছাড়া সব ঘটনা তো আর আমার দেখার কথা নয়।

যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ অনেক বড় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি দেশব্যপি এমনকি দেশের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। তাই এর সবকিছু আমার দেখার কথা নয়। এমনকি লোহাগড়ার সকল ঘটনাও আমার দেখার সুযোগ হয়নি।আমার দেখার বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাই লেখাটি মুলতঃ আমার দেখা লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ বলাই সমীচীন ছিল। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন পরে এবং কেবলমাত্র লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তাই এই লেখার নাম দিয়েছি ‘আমার স্মৃতিতে লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ’।

পূর্বেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধকালে আমি লোহাগড়া হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। লোহাগড়া এলাকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বলতে গেলে অনেকটা এই স্কুল থেকে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভুমিকা পালনকারী লোহাগড়ার যে ক‘জন শ্রদ্ধেও ব্যক্তিত্ব জীবিত অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের একজন এই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক শা ম আনয়ারুজ্জামান। প্রধান শিক্ষক ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভুমিকা রেখেছেন এই স্কুলের এমন আরো দুই একজন শিক্ষক যেমন প্রয়াত অলোক পোদ্দার ও সরদার আসাদুজ্জামান অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও এই যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতির অনেক ঘটনাই এই স্কুলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এই যেমন উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে দেখেছি অনেক মিছিল-মিটিং এই স্কুল থেকে শুরু হয়েছে। সভা-সমাবেশ হয়েছে এই স্কুলের মাঠে। নেতৃত্ব দিয়েছে এই স্কুলের সিনিয়র ছাত্ররা। গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল দিন গুলিতে সে সময়ে নবগঠিত লোহাগড়া কলেজের ছাত্ররা ছাড়াও সিডি উচ্চ বিদ্যালয়, ইতনা উচ্চ বিদ্যালয় ও লক্ষিপাশা আদর্শ বিদ্যালয় থেকেও ছাত্ররা এসে লোহাগড়া স্কুলের ছাত্রদের সাথে মিছিল মিটিংয়ে যুক্ত হয়েছে। বিরাট বিরাট সে সব মিছিলে অন্যান্যের সাথে আমিও অংশ নিয়েছি। মিছিল শেষে স্কুল মাঠে আয়োজিত সমাবেশে তৎকালীন সামরিক জান্তা আইউব খানের বিরুদ্ধে মজার মজার জারী গান লিখে এনে ছাত্ররা সমাবেশে পড়ে শোনাত।

মিছিল সমাবেশে রাজনৈতিক বক্তব্য আমাদের মত ছোটদের তেমন ভালো না লাগলেও জারী গান বা কবিতার মাধ্যমে আউইব খানের গদি ছাড়ার দাবী এবং স্বাধীনতার কথা বেশ ভালোই লাগতো। এরকম একদিনে যতদুর মনে আছে মোক্তার হোসেন নামে সিডি স্কুলের একজন ছাত্র মিছিল শেষের সমাবেশে একটি জারী গান পরিবেশন করে সকলের বেশ উৎসাহ পেল। জারী গানের একাংশ আজো আমার মনে আছে, ‘শোন চাচা আইউব খান, দিন থাকিতে ছাড়ো গদি খান ……’। সেদিন মিছিল শেষে বাড়ী ফিরে গিয়ে অভিভাবকদের কাছে স্কুল ছুটির কারণ বলতে গিয়ে ওই জারী গানের অংশ বলে ছুটির কারণ জানালাম। সে বর্ণনার দৃশ্য আজো আমার স্মৃতিপটে ছবির মত ভাসে। লেখা চলবে।

লেখকঃ সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব