কালিয়ায় সরকারি প্রকল্পের ঘর দেয়ার নামে দালাল চক্রের প্রতারণা!

7
73

স্টাফ রিপোর্টার

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাঁচুড়ী ইউনিয়নে অসহায় হত-দরিদ্রদের নিকট থেকে সরকারি প্রকল্পের ঘর পাইয়ে দেয়ার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ৫৫টি পরিবারের নিকট থেকে ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা। ফলে একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে অসহায় দরিদ্ররা প্রতারিত হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

জানা যায়, উপজেলার চাঁচুড়ী ইউনিয়নের ডহর চাঁচুড়ী গ্রামের ঋষিপল্লীর সহায় সম্বলহীন বিধবা জোসনা বিশ্বাস (৪৫)। প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করা স্বামীর নির্মাণ করা দু-চালা একটি টিন,বাঁশ ও মাটির পোতায় নির্মিত ছোট ঘর থাকলেও সংসারের অভাব-অনটনের কারণে ঘরটি কখনও মেরামত করতে পারেনি। দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিলো একটি ভাল ঘরে থাকার কিন্তু কখনও এই বিধবার স্বপ্নপূরণ হয়নি। হঠাৎ করে এক সপ্তাহ আগে একই গ্রামের মৃত আঃ হামিদ গাজীর ছেলে বিল্লাল গাজী ওরফে কানাই গাজী বিধবা জোসনা বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে জানায়, ১৫ হাজার করে টাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অসহায় মানুষদের আগামী দুই মাসের মধ্যে এক লাখ টাকা মূল্যের একটি করে ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। ওই প্রতারকের কথা মতো দীর্ঘদিনের স্বপ্নপুরণের লক্ষে ৭ হাজার টাকা স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে মাসিক শতকরা ১০ টাকা হারে ঋণ নিয়ে তাকে দিয়েছেন এবং বাকী টাকাও ধার-দেনা করে ঘর পেতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অপর একজন ডহর চাঁচুড়ী গ্রামের হাসান শেখের স্ত্রী মাটিকাটা শ্রমিক হালিমা বেগম। স্বামী-সন্তান নিয়ে টিনের তৈরি একটি কাঁচা ঘর নির্মাণ করে কোন রকমে বসবাস তাদের। তিনিও ভাল একটি ঘর পাওয়ার আশায় স্থানীয় কানাই গাজী ও তার ভাতিজা আলমগীর গাজীকে অগ্রিম বাবদ ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন বাকি ১০ হাজার টাকা ঘর বরাদ্দের পর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।

এছাড়া উপজেলার ডহর চাঁচুড়ী গ্রামের পিকুল মোল্যার স্ত্রী আনজিরা বেগম, মৃত তালেব শেখের ছেলে মিজান শেখ, মৃত তালেব শিকদারের ছেলে ইলু শিকদার,হাদিস শিকদার, লায়েব শিকদার, মৃত আকুববরের ছেলে রজিবুল শেখ, মকবুল শেখের ছেলে ইসমাইল শেখ, মৃত নয়ন মোল্যার ছেলে আলাউদ্দিন মোল্যা, মৃত আজোয়ার মোল্যার ছেলে আল-আমিন মোল্যা, মৃত আনসার শেখের ছেলে শরিফুল শেখ,সবুর বিশ্বাসের ছেলে লিটু বিশ্বাস, মৃত. কমল বিশ্বাসের ছেলে অশোক বিশ্বাস, শংকর বিশ্বাস, মৃত.লক্ষীকান্তের ছেলে দিলীপ বিশ্বাস, হিরু শেখের ছেলে হাসমত শেখ, লিয়াকত শেখ,মৃত. তোফাজ্জেল মোল্যার ছেলে ওসমান মোল্যা ও মৃত উতার উদ্দিন মোল্যার ছেলে মাসেম মোল্যা, চাঁচুড়ী গ্রামের মৃত. বদিয়ার মোল্যার ছেলে আলমগীর মোল্যা,মৃত. ছলেমান শেখের ছেলে হেমায়েত শেখ, চাঁচুড়ী গ্রামের বেপারী পাড়ার মোন্তাজ খাঁর মেয়ে জাহেদা বেগম ও কৃষ্ণপুর গ্রামের আজিজ শেখের ছেলে নাসির শেখ ও আবু সাঈদ শেখের সহায় সম্বলহীন বিধবা রুজিনা বেগমের নিকট থেকে ওই  দালাল কানাই গাজী ও তার ভাতিজা আলমগীর গাজী ঘর পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৫-৮ হাজার করে সর্বমোট ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

কালিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় সারাদেশের ন্যায় কালিয়া উপজেলাধীন যাদের জমি আছে, ঘর নেই এ প্রকল্পের আওতায় অসহায় লোকের মধ্যে সরকার বিনা খরচে গৃহ নির্মাণের কাজ চলছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত কোন বরাদ্দ আসেনি। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩২ টি ঘর বরাদ্দসহ মোট এ প্রকল্পে ১৯৭টি ঘর নির্মাণ করা হয়।

ডহর চাঁচুড়ী গ্রামের খবু গাজীর ছেলে ও দালাল কানাই গাজীর ভাতিজা আলমগীর গাজী গরীব-অসহায়দের নিকট থেকে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে যুগান্তরকে জানান,‘ আমার চাচার জামাই  (চাচাতো বোনের স্বামী) গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার জনৈক শাহজাহান ঘর পাইয়ে দিতে পারবেন এমন প্রতিশ্রুতি পেয়ে ৫৫ জন অগ্রিম আমাদের কাছে টাকা জমা দিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই ১২-১৫ হাজার করে টাকা পরিশোধ করবেন। এজন্য অগ্রিম বাবদ সর্বনিম্ন ৫ হাজার ও সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা করে মোট ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা আমার নিকট জমা দিয়েছেন। আগামী দেড়/দুই মাসের মধ্যে টাকা প্রদানকারীদের চৌদ্দ হাত লম্বা ও ৬ হাত চওড়া সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে।  যদিও আমার চাচা কানাই গাজী মাধ্যম হয়ে তার জামাইকে দিয়ে কাজ করাবেন। এখানে আমার কোন কর্তৃত্ব নেই,শুধুমাত্র এলাকার লোক চাচার জামিনদার হিসেবে আমার নিকট টাকা জমা দিয়েছেন। কোন কারণে এ টাকা খোয়া গেলে আমিই তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দিব।’

একই প্রসঙ্গে বিল্লাল ওরফে কানাই গাজী বলেন, ‘একটি বাড়ি ও একটি পায়খানা নির্মাণ বাবদ ৪০/৪৫ জনের নিকট থেকে ১৯ বন্দের একটি সেমি পাকা ঘর নির্মাণ বাবদ আমি ১৫ হাজার টাকার মৌখিক চুক্তিতে নগদ ৫-৬ হাজার অগ্রিম নিয়েছি। সচিবালয় থেকে অনুমোদন,গাড়ি ভাড়া ও খরচা-পাতির কারণে প্রতিটি ঘর দেয়ার বিনিময় প্রথমে অগ্রিম বাবদ এ টাকা নেয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে ঘর নির্মাণের সামগ্রী পৌঁছানোমাত্র বাকি টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমার ছোটপুত্র  (মেয়ের দেবর) সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা। তিনিই মূলত সচিবালয় থেকে এ ঘর অনুমোদন করিয়ে এনে দিবেন।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শাহজাহান নিজেকে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার বাসিন্দা সাজ্জাদ নামধারী দাবি করে মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন,‘মন্ত্রনালয়ে অনুমোদনের জন্য খরচ বাবদ কিছু টাকা তোলা হচ্ছে। তবে যারা টাকা দিচ্ছেন, তারা নিশ্চিতভাবে ঘর পাবেন।’

একই বিষয়ে কালিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নাজমুল হুদা বলেন,‘ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জমি আছে, ঘর নেই নামের আশ্রয়ণ প্রকল্পটি অসহায় দরিদ্র মানুষদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। এ প্রকল্পের নাম করে যদি কোন ব্যক্তি টাকা পয়সা নিয়ে থাকে এ বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে সুনির্দিষ্ট লখিত অিভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এ ব্যাপারে চাঁচুড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হিরক বলেন,‘ আমি ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি যে, আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় ঘর দেয়ার নাম করে আমার ইউনিয়নে একটি চক্র টাকা তুলছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউএনও মহোদয়ের নিকট লিখিত অভিযোগ দিব।