কবি সুকান্তের পৈত্রিক নিবাস থেকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স, লোহাগড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের আনন্দ ভ্রমণ

0
19
সার ও বীজ বিতরণ

আবদুস ছালাম খান, লেখক, সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও শীতের শেষে লোহাগড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের (কয়েকটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের লোহাগড়া প্রতিনিধিদের সংগঠন) সদস্যদের আনন্দ ভ্রমনে যাবার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সঙ্গত কারণেই বিভিন্ন জন বিভিন্ন স্থানে যাবার প্রস্তাব দেয়। তবে দীর্ঘদিন থেকে আমি সবাইকে কোটালীপাড়ায় অকাল প্রয়াত কিশোর কবি সুকান্তের পৈত্রিক বাড়ি দেখতে যাবার কথা বলে আসছি। কিন্তু অন্যদের পছন্দের গুরুত্ব দিতে গিয়ে অপর কোন স্থানে গেলেও কোটালীপাড়া যাওয়া হয়নি। তবে এবার আনন্দ ভ্রমনের কথা আলোচনায় আসতেই কোটালীপাড়া যাবার বিষয়টি সামনে আসে।

তাই কোন আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত হয় ১ মার্চ সুকান্ত মেলার সময়ে কবি সুকান্তের পৈত্রিক ভিটা দেখতে যেতে হবে। কয়েক বছর আগে পশ্চিম বাংলা (ভারত) থেকে ‘কিশোর বাহিনী’ নামে একদল লোক বাই সাইকেলে নড়াইল-লোহাগড়া হয়ে কোটালীপাড়ায় কবি সুকান্তের বাড়িতে গিয়েছিল। তারা ওই বাড়িতে কবির একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছিল। ভারতীয় দলটি আমাদের কয়েক বন্ধুর তত্ত্বাবধানে লোহাগড়ায় এক রাত্রি যাত্রা বিরতি করেছিল। দলের পুরুষ সদস্যদের লোহাগড়া পাইলট স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তবে ওই দলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থী থাকায় আমার মেয়ে উর্মি তাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে রেখেছিল। সেই থেকে কোটালীপাড়া যাবার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় মার্চ মাসের ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত কবির পৈত্রিক বাড়িতে এ বছরের সুকান্ত মেলা হবে। আমাদের সংগঠনের অধিকাংশই বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত তাই ছুটির দিন বেছে নিতে হবে। ৩ ও ৪ মার্চ শুক্র ও শনিবার বেছে নিলাম। কিন্তু পরে জানা গেল ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভা করতে কোটালীপাড়া আসছেন। রাস্তাঘাটে অতিরিক্ত ভীড়সহ বিভিন্ন বিষয় ভেবে তারিখ পরিবর্তন করে ১১ মার্চ তারিখ নির্ধারণ করা হলো। আর্থিক ব্যবস্থাপনা সহ সার্বিক তত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয় সংগঠনের সদস্য (ইত্তেফাক প্রতিনিধি) শরিফুল ইসলাম আক্কাসকে। তার সাথে সমন্বয় করবে সভাপতি (ভোরের কাগজ প্রতিনিধি) প্রভাষক আবু আবদুল্লাহ। তবে তারা কোটালীপাড়া ভ্রমনের সাথে যুক্ত করে টুঙ্গীপাড়া বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি কমপ্লেক্স দেখা।

১১ মার্চ ২০২৩ সকাল ৯ টায় আমরা ৫ জন (আকরামুজ্জামান মিলু , আবু আবদুল্লাহ, মাহফুজুল ইসলাম মুন্নু , শরিফুল ইসলাম আক্কাস ও আমি) কালো রংয়ের একটি মাইক্রো বাসে লোহাগড়া সাংবাদিক ইউনিয়য়ন অফিসের সামনে থেকে কোটালীপাড়ার উদ্দেশে রওনা দেই। আমাদের সকলের গায়ে একই রংয়ের গেঞ্জি। মিলুভাই আমাদের সংগঠনের সদস্য না হলেও সিনিয়য়র সাংবাদিক হিসাবে চলা-ফেরায় আমাদের ঘনিষ্টজন। তাই তাকেও সঙ্গে নিয়েছি। লোহাগড়া থেকে নব নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মধুমতি নদীর কালনা সেতুর উপর দিয়ে ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ হয়ে কোটালীপাড়ার দুরত্ব ৬০ কিলোমিটার হবে।

আবার কোটালীপাড়া থেকে টুঙ্গীপাড়া যাবার পথ আরো ৩০ কিলোমিটার হবে। গোপালগঞ্জ থেকে কোটালীপাড়া সড়ক ধরে এগিয়ে কাঠি বাজারে চা বিরতি করি। চা পানের পর আবার পথচলা। পথে ঘাঘর বাজার পৌছে জানলাম ঘাঘর বাজার নিয়েই কোটালীপাড়া উপজেলার কোটালীপাড়া পৌর শহর।

ঘাঘর বাজারটি ঘাঘর নদীর পাড়ে বেশ সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন জনপদ। আগামী ২০ মার্চ কোটালীপাড়া পৌর সভা নির্বাচন। জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। তবে জানা গেল আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেয়ে মতিয়ার রহমান হাজরা বিনা প্রতিদন্দিতায় মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এখন শুধু কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হবে ।
কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদের সামনে থেকে ঊনশিয়া গ্রামে কবির পৈত্রিক বাড়ির দুরত্ব অন্ততঃ ২ কিলোমিটার হবে। গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি পাকা হলেও অপ্রশস্ত ও অত্যধিক আঁকা-বাঁকা।

পথে বার বার জিজ্ঞাসা করে ওই বাড়িতে পৌছাই। ২০১০ সালে গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ কবির পৈত্রিক ভিটায় ‘কবি সুকান্ত পাবলিক লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম’ নামে একটি সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ করেছে। লাইব্রেরির সামনে ব্যয়বহুল একটি স্থায়ী মঞ্চ নির্মানের কাজ চলমান। মূল ভবনের দুই পাশে ভ্রমনে আসা দুইটি সংগঠনের অনুষ্ঠান চলছে। বাড়ির সামনে সদ্য সমাপ্ত সুকান্ত মেলা শেষের জের তখনও দৃশ্যমান।

লাইব্রেরিয়ান সুজন হালদার জানান, সুদৃশ্য এই লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম নির্মাণের পর থেকে কবির মৃত্যুদিন (১৩ মে) আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা শুরু হয়। কিন্তু দুই বৎসর ওই সময় সুকান্ত স্মরণসভা করতে গিয়ে বৃষ্টি-বর্ষায় অনুষ্ঠান পন্ড হয়। তার পর থেকে ১ মার্চ কবির পৈত্রিক বাড়ির সামনে ‘সুকান্ত মেলা’ হয়ে আসছে। প্রকৃত পক্ষে কবির জন্মদিন ১৫ আগস্ট ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ (জন্মস্থান কালিঘাট ,ভারত) এবং মৃত্যু ১৩ মে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। জানা যায় পশ্চিম বঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কবির ভ্রাতুষ্পুত্র। লাইব্রেরিয়ান সুজন হালদার আরো জানান, জেলা পরিষদ দায়িত্ব গ্রহনের আগে কবি পরিবারের সমস্ত জমি বেদখল হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে বেদখল হওয়া জমির অংশিক উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। সুকান্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে কবির লেখা ও কবিকে নিয়ে লেখা বই এবং কবি পরিবারের ব্যবহার্য বিভিন্ন ধরণের সংগ্রহ দেখে খুব ভালো লেগেছে।

মার্কসবাদী চেতনায় বিশ্বাসী মানবতার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতার বই ছাড়পত্র ,পূর্বাভাস সহ কয়েকটি বই ওলট পালট করে দেখলাম। পরিচয় জেনে লাইব্রেরিয়ান তাদের পরিদর্শন বইতে কিছু লিখতে অনুরোধ করে। তাই সেখানে কবি সুকান্ত পাবলিক লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম দেখে ভালো লাগার বিষয়ের সাথে কবি পরিবারের বেদখল হওয়া সম্পত্তি দ্রুত পুনঃরুদ্ধারে সচেষ্ট হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে জোর পদক্ষেপ গ্রহনের অনুরোধ জানিয়ে এক ছত্র লিখেছি। কবির বাড়িতে আবুল কালাম মৃধা নামে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হয়। সে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। কবির বাড়ি দেখা শেষ করে আমরা কোটালীপাড়ায় ফিরে আসি। উপজেলা পরিষদের সামনে গাড়ী রেখে সামনের দোকানে বসে চা-বিস্কুট খেয়ে আশ-পাশ ঘুরে দেখে টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশে রওনা দেই। কোটালীপাড়া থেকে টুঙ্গীপাড়া আবার সেই আঁকা-বাঁকা রাস্তা। তবে গ্রামীন এই রাস্তাটি বেশ প্রশস্ত।

কবি সুকান্তের বাড়ি দেখে স্বপ্ন পূরণের তৃপ্তির সাথেই টুঙ্গীপাড়া ফিরে এলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌছে সঙ্গত কারণেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। ছুটির দিন হওয়ায় ওইদিন দর্শণার্থীর আগমন ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে যেহেতু পূর্বে একাধিকবার ওই খানে গিয়েছি তাই সবকিছুই পরিচিত। তারপরও আশ-পাশ ঘুরে দেখি। শেখ পরিবারের জরাজীর্ণ পুরাতন ভবনটি পূর্বের আদল ঠিক রেখে সংস্কার কাজ চলমান দেখে ভালো লাগল। এরপর মাজার ভবনের ভেতরে ঢুকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পিতা-মাতার কবর জিয়ারত করি। প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখি জোহরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। তাই বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স মসজিদে নামাজ আদায় করি এবং বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল প্রয়াত সদস্যের প্রতি দোয়া করি। এরপর মধ্যাহ্ন ভোজ ও বাড়ি ফেরার পালা। আমরা গোপালগঞ্জ শহরের একটি হোটেলে মাছ-গোশত দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে লোহাগড়ার উদ্দেশে রওনা দেই। বিকাল ৪টার মধ্যে আমরা লোহাগড়ায় ফিরে আসি।