লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ ডিসেম্বর ১৯৭১ লোহাগড়া থানা শত্রুমুক্ত হয়

0
11
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চলাচল সীমিত হয়ে যায়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চলাচল সীমিত হয়ে যায়

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমনে সারা দেশের পাকবাহিনী এবং রাজাকার-আলবদর বাহিনীসহ তাদের দোসররা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের খবরে পাকসেনা ও রাজাকাররা যেমন ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে তেমনি মুক্তিযোদ্ধারা অধিক উৎসাহে সংগঠিত হতে থাকে।

এদিকে ৬ ডিসেম্বর একই দিনে ভুটান ও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। ওই দিনেই মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমনে পাক আর্মিরা যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনার দিকে পশ্চাদাপসারণ করে গিলাতলা সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়। যশোর সেনানিবাস মুক্তিবাহিনীরা দখল করে নেয় এবং যশোর জেলাকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা ঘোষণা করা হয়। এদিকে ভাটিয়াপাড়ার পাকসেনারা পূর্ব থেকেই লোহাগড়া ও গোপালগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমনে ক্যাম্পের মধ্যে আশ্রয় নেয়। অর্থ্যাৎ মুক্তিযোদ্ধারা লোহাগড়া থানা আক্রমণ করলে তাদের সাহায্য করার জন্য আর কোন পাকি সৈন্য আসবে না – এটা নিশ্চিত হয়েই মুক্তিযোদ্ধারা লোহাগড়া থানা দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে থানায় অপারেশন চালানোর আগে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার-পুলিশদের আত্মসমর্পণের জন্য চুড়ান্ত নোটিশ পাঠায়। কিন্তু ওরা আত্মসমর্পণে রাজী হয় না। মুক্তিযোদ্ধারা ৮ ডিসেম্বরকে লোহাগড়া থানা দখলের চুড়ান্ত দিন হিসাবে বেছে নেয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের থানা অপারেশনের এই গোপন সিদ্ধান্ত আমাদের পরিবার পূর্বরাতেই জেনে যায়। উল্লেখ্য আমার বড়ভাই আতিয়ার রহমান খান (টুলু) ভারতের টালিখোলা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে ইতনার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংযুক্ত থাকে। থানা অপারেশনের পূর্ব রাত্রিতে সে হঠাৎ কয়েক ডজন টর্চ লাইটের ব্যাটারী (ড্রাইসেল ব্যাটারী) হাতে অপর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে বাড়ি আসে। দ্রুত বাড়ির সবার সাথে দেখা করে যাবার সময় গোপনে জানিয়ে যায়-ভোর রাতেই থানা আক্রমন করা হবে। গোলাগুলি শুরু হলে আমরা যেন নিরাপদ অবস্থানে আশ্রয় নেই।

তবে তিনি এও জানিয়ে যান যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি এতটাই যে রাজাকার-পুলিশরা বেশিক্ষন টিকতে পারবে না। তাই তোমাদের বাড়ি ছেড়ে বেশি দুরে যাবার দরকার নেই। এদিকে আমার চাচা রফিউদ্দিন খান তখন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য। যে কোন গোলাগুলির সময় পরিবারের নিরাপত্তার জন্য তিনি পূর্বেই উঠানের পাশে একটা বড় বাংকার কেটে রেখেছিলেন। ভোর রাতে গোলাগুলি শুরু হলে আমাদের বড়ির সবাই ওই বাংকারে আশ্রয় নেয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে লোহাগড়া থানা এলাকায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বা পুলিশদের অনেক অপকর্ম স্বচক্ষে দেখেছি। একইভাবে থানা দখলমুক্ত করা যুদ্ধের কিছু অংশ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এক পর্যায়ে আমি ওই যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হয়ে যাই। ফলে থানা দখলমুক্ত করার সে যুদ্ধ আমার স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করে। তৎকালে থানায় একজন সাব ইন্সপেক্টর র‌্যাংকের পুলিশ কর্মকর্তা ওসি হিসাবে থানা প্রধান থাকলেও লোহাগড়া থানায় ছিল ব্যতিক্রম। এখানে একজন ওসি থাকলেও খালেক পুলিশ নামে একজন কনস্টবলই ছিল কার্যতঃ থানা প্রধান। তার এতটাই দাপট ছিল যে সবাই তাকে দারোগা মনে করতো। কেউ কেউ ওসিও মনে করতো। আমরা কুন্দশী গ্রামের লোকেরা কখনো কখনো পাক আর্মিদের চাইতে ‘খালেক পুলিশ আতঙ্কে’ থাকতাম বেশি। তাই থানা দখলের দিনে খালেক পুলিশের পরিণতি দেখার কৌতুহল ছিল বেশি।

মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখলের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পূর্বদিন সন্ধ্যার পর অর্থ্যাৎ ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর পরই যার যার পজিশনে চলে যায়। ০৮ ডিসেম্বর ভোর ৪ টা। ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট ফুটে ওঠেনি। পুর্ব থেকেই থানার চার পাশে ঘিরে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ভোর হওয়ার আগেই একযোগে থানায় আক্রমণ চালায়। শুরু হয় উভয় পক্ষে প্রচন্ড গুলি বিনিময়। রাজাকাররা থানা ছাড়াও লক্ষিপাশা বাজার ও খেয়াঘাটে বাংকার করে পজিশনে আছে। তারা যার যার বাংকার থেকে বৃষ্টির মত গুলি চালাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা একটা গুলি করলে ওরা ৫টা গুলি করছে। ঘন্টা খানেক তুমুল গুলি বিনিময়ের পর রাজাকাররা পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে গুলির মাত্রা কমিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশরা সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়।

আমরা কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম এদিকে তেমন গুলি আসছে না। অর্থ্যাৎ পুলিশ রাজাকারদের গুলি করা কমে গেছে। রাস্তায় দুই-একজন লোক দেখা যাচ্ছে। আমি তখন এক পা দুই পা করে থানার দিকে এগিয়ে নবগঙ্গা নদীর পাড়ে যাই এবং একটা বড় শিমুল গাছের ‘বাড়ন্ত পটের’ আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখি নদীর ওপারের পাড় ধরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নীচু হয়ে থানার দিকে দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ততক্ষণে ভোরের সূর্য উঠে গেছে। আমি তখন টুটু রায় নামে আমার এক প্রতিবেশি কিশোরকে সাথে নিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে যাবার জন্য জেলে পাড়ার দিকে এগোতে থাকি। কিন্তু কোথাও কোন নৌকা না পেয়ে লোহাগড়া বাজারের কাছে চলে গেলাম। বাজার সংলগ্ন কাড়াল পাড়ার সোজা নদীর চরে জরাজীর্ণ একখানি বড় নৌকা পড়ে থাকতে দেখে আমার মত কয়েকজনকে নিয়ে নৌকাটি পানিতে ভাসিয়ে পারের উদ্দেশে নৌকায় উঠি।

কিন্তু নৌকাটি ভাঙ্গাচোরা হওয়ায় দেখি তাতে পানি উঠছে। হাতের কাছে কোন বৈঠা না পেয়ে আমরা বাঁশের চটা ও হাত দিয়ে বেয়ে যেতে যেতে নৌকাটি পানিতে ভরে যায়। কিনারে পৌছানোর আগেই আমরা লাফ দিয়ে পাড়ের কাঁদা-পানিতে পড়ে দ্রুত থানার দিকে এগিয়ে যাই। মুক্তিযোদ্ধারা ততক্ষণেও থানার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সব পুলিশ ও রাজাকারদের ধৃত করতে পারে নাই। আমিও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের খুঁজে বের করতে লেগে গেলাম।

এক পর্যায়ে দেখি থানার সামনের (ত্রিমোহনায়) রাস্তায় দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা একজন রাজাকারের হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে নিয়ে এসে গুলি করতে উদ্ধত। তারা চিৎকার বলছে-‘তুই আমার ভাইকে মেরেছিস। তোর জন্যই আমরা দুইভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছি’। ওই রাজাকার তার হাত খুলে গুলি করতে অনুরোধ করলেও মুহুর্তে দুই সহোদরের নতুন এস এল আরের ব্রাশ ফায়ারে তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মাথার ঘিলু বের হয়ে যায়। ভাই হত্যার প্রতিশোধের এ নৃশংস দৃশ্য দেখে আমার সঙ্গী কিশোরটি ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে।

আমরা স্থান ত্যাগ করে খুঁজতে থাকলাম সেই কুখ্যাত খালেক পুলিশকে। এ সময় দেখি চান মিয়া নামে চরকরফার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই কাঁধে দুইটা রাইফেল নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে আসছে। তার হাতে একটা মুড়ির টিন। ওর কাছে খালেক পুলিশের কথা জানতে চাইলে সে জানায় তার কাছের অতিরিক্তটা খালেক পুলিশের রাইফেল। তবে টিনের ভিতরে কি ছিল তা জানতে চাইনি। সে জানায় মুক্তিযোদ্ধারা ওকে লক্ষিপাশা স্কুলের দিকে ধরে নিয়ে গেছে। একথা বলে চান মিয়া দ্রুত বাড়ির উদ্দেশে খেয়াঘাটের দিকে চলে এলো।

আমরা দু‘জনে লক্ষিপাশা হাই স্কুলের দিকে যেতে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে দেখি রাজাকার কমান্ডার ফজলে করিম রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে কাতরাচ্ছে। তার পাছার খানিকটা মাংস গুলিতে উড়ে গেছে। রক্তে হাসপাতালের বারান্দা ভেসে গেছে। তার হাতের নাগালের বাইরে ছোট্ট একটা বালিশ পড়ে আছে। সে আমাদের দেখে বালিশটা এগিয়ে দিতে বলে। কিন্তু তার রক্তাক্ত অবস্থা এবং পাকানো বড় গোঁফ দেখে আমরা কিছুটা ভয় পেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।

আমরা হাসপাতালের উত্তর পার্শ্বের রাস্তায় গিয়ে দেখি একদল লোক খালেক পুলিশের দুই পা জিআই তার দিয়ে বেঁধে টেনে লক্ষিপাশা খেয়া ঘাটের দিকে নিয়ে আসছে। আমরা ওদের পিছু অনুসরণ করলাম। ওই লোকগুলি মৃত প্রায় খালেক পুলিশকে টেনে এনে খেয়া ঘাটের উপর থাকা পাহাড়ি নিম গাছের সাথে পা উপরের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে দিল। ওর দেহে গুলি ও বেয়নেটের জখম দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছিল এবং সে কোন রকমে জীবিত ছিল। এ দৃশ্য দেখে ক্ষমতার দাপট কার কতক্ষণ তা ভাবতে ভাবতে বাড়ি আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ততক্ষণে খেয়াঘাটে নৌকা পারপার শুরু হয়ে গেছে। পারের উদ্দেশে ঘাটের দিকে নামতেই দেখি মুক্তিযোদ্ধারা একদল রাজাকারের হাতে দড়ি বেঁধে (গরু বাঁধার মত) নিয়ে আসছে। রাজাকারদের কেউ কেউ আমার পরিচিত হলেও কাউকে কিছু না বলে পার হয়ে চলে এলাম। আত্মসমর্পণ করা পুলিশদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থানায় রাখা হয় এবং রাজাকারদের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়।

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার ও পুলিশের দখলে থাকা লোহাগড়া থানা ও থানা সংলগ্ন লক্ষিপাশা এলাকা দখল করে নেয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মাত্র ঘন্টা চারেকের সন্মুখ যুদ্ধে লোহাগড়া থানা এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসলেও সে যুদ্ধে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের গুলিতে শাহাদত বরণ করে। তাদের একজন উপজেলার কোলা গ্রামের হাবিবুর রহমান এবং অপরজন যশোর সদর উপজেলার জঙ্গল-বাঁধাল গ্রামের মোস্তফা কামাল তাজ। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ভারতের টালিখোলা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহনকালীন সময় ইতনা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য এ অঞ্চলে চলে আসেন। লোহাগড়া থানাকে দখলমুক্ত করার সন্মুখ যুদ্ধে শহীদ হলে তাকে ইতনা হাইস্কুল মাঠে জানাজা শেষে সেখানেই সমাহিত করা হয়। ইতনা হাই স্কুলের প্রবেশ মুখে শহীদ মিনারের পাশে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আজো চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। আর কোলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হাবিবুর রহমানকে লোহাগড়া থানা কম্পাউন্ডের মধ্যেই সমাহিত করা হয়। লোহাগড়া থানার নতুন ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। লেখা চলবে…(লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক)