লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রাধিকার পাবে এমন কথা তখন চাউর ছিল

0
18
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ- পুনরায় যশোর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ

এডঃ আবদুস ছালাম খান

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা ছিল দ/খলদার পাকিস্তানীদের এ দেশ থেকে বিতা/ড়িত করা। এজন্য যা যা করা দরকার তার সবই করতে প্রস্তুত ছিল এ দেশের মানুষ। মুক্তিকামী মানুষের এ আকাঙ্খা দমনে পাকিস্তানীরাও মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশের সর্বত্র গণহ/ত্যা, লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ ও না/রী নির্যা/তনের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলতে থাকে। নির/স্ত্র মুক্তিকামী জনতা তখন শস/স্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হতে ট্রেনিং নিয়ে যু/দ্ধের মাধ্যমে তাদের বিতা/ড়িত করতে বেরিয়ে পড়ে। তখন শরণার্থীদের সাথে দলে দলে ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যেতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের এই কঠিন দুঃসময়ে ভারত সরকার ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পরে মুক্তিযুদ্ধে গতি লাভ করে। এই মুজিব নগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেত্বতেই মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠন ও কুটনৈতিক তৎপরতায় নয় মাসের শসস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক সদর দপ্তরসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের দপ্তরও ছিল ভারতের ভুখন্ডের মধ্যে। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত রাজ্যে গড়ে উঠেছিল ছিল অসংখ্য শরণার্থী শিবির।

এসব শরণার্থী শিবিরে এক কোটিরও বেশী বাংলাদেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। শরণার্থীদের একাংশ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে শস/স্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দলে দলে শরণার্থী যেতে দেখে আমরা যুবক শ্রেণীর কোন দল দেখলে মনে মনে ধরে নিতাম এরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যাচ্ছে। তবে যুবকরা তখন বেশ কৌশলে পথ চলতো। তাদের দেখে যাতে শ/ত্রুরা সহজে বুঝতে না পারে সে বিষয়ে তারা বেশ সতর্ক ছিল। জুলাই-আগষ্ট মাসের এরকম একদিন হঠাৎ বৃষ্টি নামায় একদল যুবক দৌড়ে আমাদের বাড়িতে ওঠে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল ওরা বরিশাল জেলার মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যাচ্ছে। যুবকদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। এটা তাদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল।

আমাদের পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এটা বুঝতে পেরে ওরা আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে নানা কথা বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহিত করে। ওরা আমাদের দুই ভাইকে দেখে তাদের সাথে আমাদের ভারতে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু আমরা তখনই ভারতে যেতে প্রস্তুত না থাকায় ওদের না বলে দিলাম। তাতে ওরা আমাদের জানায় তাদের এলাকায় পাক বাহিনী ও রাজাকারের অ/ত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে তাদের পরিবার থেকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যেতে উৎসাহিত করছে। সেখানে আমাদের পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করায় ওরা বিষ্মিত হয়। তবে এর কিছুদিন পর অবশ্য আমার বড়ভাই আতিয়ার রহমান টুলু বাড়ির কাউকে এক রকম না বলেই তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যায়।

নভেম্বর মাস পর্যন্ত ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে প্রবেশ করেছিল এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা। এসময় আরো এক লাখ যুবক প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষনের অপেক্ষায় ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন নামের বাহিনী হিসাবে পরিচিত ছিল। তৎকালে মুক্তি বাহিনী ও মুজিব বাহিনী বা গেরি/লা বাহিনীর পার্থক্য বুঝতাম না। আমরা ধরে নিতাম সকলেই মুক্তি বাহিনী। পরবর্তীকালে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকালের এসব পৃথক পৃথক বাহিনী গঠনের ‘শানে নযুল’ কিছু কিছু বুঝেছি।

তৎকালে বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা বলে পরিচিত চার যুবনেতা অর্থ্যাৎ শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ এর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ’ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গড়ে উঠা এই বাহিনীই মুজিব বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। মুক্তি বাহিনী গঠনের সূচনা লগ্নে এই চার নেতাই মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। মুজিবনগর সরকার গঠনসহ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মত পার্থক্যের কারণে তারা এই পৃথক বাহিনী গঠন করেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে- এই ধারনা থেকেই মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। মুজিব বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেয় চার হাজার যুবক। তবে দেশের অভ্যন্তরের ইউনিট গুলিতে অনেক যুবককে এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগ ঘরানার বাইরের কেউ মুজিব বাহিনীতে রিক্রুট হতে পারতো না। ভারত সরকার সংগঠনটির প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সহায়তা প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ভারতের সহায়তায় গঠিত হয় আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। যা ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের ‘গেরিলা বাহিনী ’ নামে পরিচিতি পায়। ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর ১৪০০ যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এসময় আরো কয়েক হাজার যুবক তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষনের অপেক্ষায় ছিল। (তথ্য সূত্রঃ আবু সাঈদ খানের প্রবন্ধ -‘বাংলাদেশ সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ’ দৈনিক সমকাল, ২৬ অক্টোবর ২০২১)।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে সর্বকালের ভয়াবহ বন্যা হয়। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসের ভ/য়াবহ এ বন্যায় সারা দেশে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। এমন কোন বাড়ি ছিল না যেখানে পানি ওঠে নাই। লোহাগড়া বাজারের মধ্যেও পানি উঠে গিয়েছিল। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির ঘরের মধ্যেও পানি ঢুকে যায়। অনেক গ্রামের রাস্তাঘাটও পানিতে ডুবে যায়। পানির তোড়ে রাস্তাগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গরু-ছাগল নিয়ে সেকি দুর্ভোগ। অনেক বাড়িতে মানুষের ন্যায় গরু-ছাগলও মাচার উপর রাখতে দেখা যায়। আমাদের বাড়িটি গ্রামের অনেক বাড়ি থেকে অপেক্ষাকৃত উচু হলেও এক পর্যায়ে পানি উঠে যায়। একদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা অন্যদিকে ভয়াবহ বন্যায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। গ্রামে চরম অভাব দেখা দেয়। অভাবের তাড়নায় কেউ কেউ রাজাকারে নাম লেখায়। তখন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিলে বেশ টাকা পাওয়া যেত। এ সময় কালনায় সিএন্ডবি রাস্তার মাথায় বাজার মিলতো। একদিন ওই বাজার থেকে আসার পথে দেখি- মাইটকুমড়া গ্রামের একজন লোককে কয়েকজন রাজাকাররা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম লোকটিকে বোধ হয় রাজাকাররা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা চলে যাবার পর ওই পরিবারের এক মহিলার কাছ থেকে শুনলাম-ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না। অভাবের তাড়নায় লোকটি রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাতে লক্ষিপাশা যাচ্ছে। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে লোকটিকে আমি পূর্ব থেকেই চিনতাম। লোকটি এখন বেঁচে নাই। যতদুর মনে পড়ে তার নাম চান্দু হবে। লোহাগড়া থানা দখলের দিনেও তাকে পিঠ মোড়া করে বাঁধা দেখেছি।

এসময় নবগঙ্গা নদীর এপারে অর্থ্যাৎ লোহাগড়ার পার বলতে গেলে নকশালদের দখলে এবং লক্ষিপাশা রাজাকারদের দখলে। মুক্তিযোদ্ধারা তখনও দেশে ফিরে আসেনি। মুক্তিযোদ্ধারা যে তখন ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে ব্যস্ত রয়েছে-অবিলম্বে পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে আসছে- এমন খবর সাধারণ মানুষের জানা সহজ ছিল না। তাই অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল। এরকম একটি হতাশাজনক সময়ে অর্থ্যাৎ সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে আসেন গোবিন্দপুর গ্রামের জিল্লুর রহমান ( জিল্লাল ভাই) নামে আমাদের এক বড় ভাই। বয়সে তিনি আমার বেশ সিনিয়র। তিনি আমার প্রতিবেশি দেবদাস রায়ের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তাই পূর্ব থেকেই তাকে ভাল করে চিনতাম। একদিন তিনি একটি স্টেনগান হাতে দেবদাস রায়ের বাড়িতে আসেন। জিল্লাল ভাই ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেছেন তাই তাকে দেখতে ওই বাড়িতে গেলাম। জিল্লাল ভাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে নানা কথা বলে আমাদেরও মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে যেতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত আমার মত কয়েকজন জিল্লাল ভাইয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিতর্ক শুরু করলাম।

আমাদের বিতর্কটা এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবার বিপক্ষে চলে গেল। জিল্লাল ভাইকে দেখে তখন বোঝা যাচ্ছিল তিনি আমাদের কথায় বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তবে তিনি রেগে না গিয়ে আমাদের বললেন- ‘দেখ দেশ স্বাধীন হলে চাকরি-বাকরি সব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধরাই অগ্রাধিকার পাবে’। জিল্লাল ভাইয়ের এ কথায় বোঝা যাচ্ছিল এ ধরণের কথা তখনও লোকমুখে প্রচারিত ছিল। যদিও সে কালে এদেশের মানুষ দেশ স্বাধীন হলে কে কী পাবে তা নিয়ে ভেবে-চিন্তে মুক্তিযুদ্ধে যায় নি। বরং গানের সুরে বলতে হয়-‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না- বড় বড় লোকেদের ভীড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে তোমাদের নাম লেখা রবে না। তবু এ মুক্তিসেনা ….। লেখা চলবে। (লেখক-সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক)