শিশুর সুরক্ষায় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন

10
8

মনোজিৎ মজুমদার

সারাদেশে একযোগে জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন পালিত হচ্ছে। চার দিনের এ কর্মসূচি চলবে ১১ ডিসেম্বর শনিবার থেকে ১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ছয় থেকে ১১ মাস বয়সি প্রায় ২৩ লাখ শিশুকে একটি করে নীল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল (এক লাখ আই.ইউ) এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সি প্রায় এক কোটি ৮৭ লাখ শিশুকে একটি করে লাল রঙের (দুই লাখ আই.ইউ) ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে। দেশব্যাপী দুই কোটির বেশি শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর শনিবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেন।

সারাদেশে এক লাখ ২০ হাজার কেন্দ্রে শিশুকে জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের আওতায় ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে। ওয়ার্ড পর্যায়ে ইপিআই আউট রিচ সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতালের ইপিআই কেন্দ্র ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেন্দ্র করা হয়েছে। এ ছাড়া শহরাঞ্চলে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান যেমন- সূর্যের হাসি ক্লিনিক, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং মেরিস্টোপের মতো বিভিন্ন বেসরকারি এনজিওগুলোতে শিশুদের ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর হচ্ছে। প্রতিটা কেন্দ্রে হেলথ ওয়ার্কারের সঙ্গে দুজন করে স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। প্রত্যেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের তত্ত্বাবধান করতে স্বাস্থ্য সহকারী ও হেলথ ইন্সপেক্টর নিয়োজিত রয়েছে। পাশাপাশি এনজিও কর্মীরাও সহায়তা করছে। তবে করোনার কারণে এবার বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনগুলোতে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র পরিচালনা বন্ধ রয়েছে।

আগামী প্রজন্মকে সুস্থ ও সবল রাখতে ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের কোনো বিকল্প নেই। ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল শিশুর জন্য অত্যন্ত নিরাপদ। শিশুর অন্ধত্ব রোধ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল অপরিহার্য। কোনো শিশু যেন ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর সরকারি এ কার্যক্রম থেকে বাদ না পড়ে, সেই উদ্দেশে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করে শিশুকে ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে।

পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ও মৃত্যু ঝুঁকি কমিয়ে আনতে উচ্চশক্তির ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এখন দেশেই তৈরি হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল এ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন) বাংলাদেশকে এ ক্যাপসুল তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর ২০২১ জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় পুষ্টি সেল এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভায় বিষয়টি জানানো হয়। এর আগে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। খুশির খবর হলো অতি নিকটে বাংলাদেশে কোভিড ভ্যাকসিনও তৈরি হবে। ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাপসুল শিশুদের কোভিড থেকে সুরক্ষিত রাখবে বলেও চিকিৎসকগণ জানিয়েছেন।

শুধু ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল নয়, বয়স দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে দেশের ৮২ শতাংশ শিশু জীবনরক্ষাকারী টিকা পেয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই হার ৯৯ শতংশ। টিকার এই সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে প্রসংশিত হয়েছে। এর পেছনে আছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই। ‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির এই আহ্বান সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই মা-বাবা জেনে যান শিশুর টিকা দেয়ার বিষয়টি। কত দিন পরপর শিশুকে টিকা দেয়া হবে তা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়। টিকা পেয়ে শিশু থাকে সুরক্ষিত।

-০২-

বাংলাদেশ এখন ভ্যাকসিন হিরো’র দেশ। তবে এই পরিবেশ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে টিকাদানে বাংলাদেশ এ সাফল্য অর্জন করেছে।

সত্তরের দশকে শিশুমৃত্যু ছিল অনেক বেশি। শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। এসব ব্যাধি থেকে শিশুকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে দেশে শুরু হয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি। শুরুতে শিশুদের ছয়টি রোগের টিকা দেওয়া হতো। রোগের তালিকায় ছিল যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুস্টংকার, পোলিও ও হাম। টিকা পেত মূলত শহরের শিশুরা। ১৯৮৫ সাল নাগাদ ২ থেকে ৩ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ১৯৯০ সালে ইপিআই সেবা সব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয়া শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল এবং মা ও নবজাতকের ধনুস্টংকার নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়; ২০০৩ সালে শুরু হয় হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া; ২০১২ সালে এমআর টিকা এবং হামের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়; ২০১৫ সালের মার্চে পিসিভি ও আইপিভি টিকা দেওয়া শুরু হয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় দেশে বর্তমানে ১০ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। ০ থেকে ১০ বছর বয়সি সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম সব নারী টিকা কর্মসূচির আওতায় এসেছে।

ইপিআই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ফলে ২০০৮ সাল থেকে মা ও নবজাতকের ধনুস্টংকার দূরীকরণ সম্ভব হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে পোলিও নির্মূল সনদ লাভ করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পোলিও নির্মূল দেশের স্বাস্থ্যখাতের একটি বিরাট সাফল্য যা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো অর্জন করতে পারেনি। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে ইপিআই কর্মসূচির কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম। তারা দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন। মাঠকর্মীরা বছরের পর বছর কাজটি আন্তরিকতার সাথে করে চলেছেন। সারা দেশের টিকাকেন্দ্রগুলো তারা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে থাকেন। তারা নিরাপদে টিকা দেন। পাশাপাশি আছে শক্তিশালী নজরদারির ব্যবস্থা। সার্বিকভাবে টিকা কর্মসূচির এই সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের শিশুরা।

টিকাদান কর্মসূচিকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনা করা হয়। এই সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। টিকাদানে অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের বোর্ড চেয়ারপার্সন এনগোজি ওখানজো ওয়েলা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করেন। করোনা অতিমারিতে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যু হার কম হওয়ার পেছনে অনেকেই টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। স্বাস্থ্যখাতের এই সাফল্যকে আরো এগিয়ে নিতে প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।