বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়

7
14
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পূর্বে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষনায় তিনি পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনাটি ইপিআরের (পরে বিডিআর এবং বর্তমানে বিজিবি) অয়্যারলেসের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ঘোষনাটি চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে প্রথম প্রচারিত হয়।

এদিকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি শোনার পর তাৎক্ষনিক করণীয় নিয়ে আলোচনা করার মত নেতৃস্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের অধিকাংশই সেদিন ঢাকায় ছিলেন। বিশেষ করে নব নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) লেঃ মতিয়ার রহমান, থানা আওয়ামীলীগ সভাপতি সরদার তসলিম উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বাদশা ও ইতনার আ জ ম আমিরুজ্জামান সেদিন ঢাকায় ছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিঞা মার্চ মাসের শুরু থেকে অর্থ্যাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দেলন তুঙ্গে উঠার পরই লোহাগড়ায় চলে আসেন।

স্বাধীনতার ঘোষনাটি লোহাগড়ায় সর্বপ্রথম পান লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান। ভাটিয়াপাড়া অয়্যারলেসের মাধ্যমে ঘোষনাটি তাঁর কাছে আসে। ওয়াহিদুর রহমান তাঁর ‘লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে লেখা প্রবন্ধে লিখেছেন, “২৬ মার্চ ‘৭১ সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা আমি পেয়ে যাই অয়্যারলেসের মাধ্যমে। অয়্যারলেস স্টেশনটি মধুমতি নদীর পূর্বপাড়ে ভাটিয়াপাড়ায়। আমার এক ছাত্র ছিল ডাক নাম পটু, ভাটিয়াপাড়া অয়্যারলেস কর্মকর্তা পটুর মাধ্যমে ম্যাসেজটি আমার নিকট পাঠিয়ে দেন।’ তিনি আরো লিখেছেন, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিঞা এ সময় আমার বাসায় অবস্থান করছেন। প্রায় একমাস ধরে তিনি লোহাগড়া থানার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে সভা-সমিতি করে মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন ’। ওই প্রবন্ধে তিনি আরো লিখেছেন, ‘নুর মোহাম্মদ মিঞা ঘোষনাটি আমার হাত থেকে নিয়ে বললেন- ওয়াহিদ দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমাদের এখন স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবেÑচল বেরিয়ে পড়ি’। যেহেতু আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ লোহাগড়ায় নেই। তাই নুর মোহাম্মদ মিঞা উপস্থিত আনয়ারুজ্জামান ও ওয়াহিদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করে দ্রুত অস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা নড়াইল ট্রেজারী থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যে কথা সেই কাজÑতিনি তাৎক্ষনিক নড়াইল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লোহাগড়া বাজারের অজয় মজুমদার নামক একজন ঔষধ ব্যবসায়ীর একটি মোটর সাইকেলে করে তাঁরা নড়াইল যান। ছোট্ট একখানি মোটর সাইকেলে চালকসহ তিনজন চাপাচাপি করে নড়াইল যান। পরে কয়েকজন ছাত্র নেতারা নড়াইল গিয়ে তাঁদের সাথে যুক্ত হন।

নড়াইল মহাকুমা প্রশাসক (এস ডি ও ) কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী সেদিন নড়াইলে ছিলেন না। এ টি এম গিয়াস উদ্দিন (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বে ছিলেন। নুর মোহাম্মদ মিঞা নড়াইলে আওয়ামীলীগ নেতাদের নিয়ে গিয়াস উদ্দিনের সাথে পরামর্শ করে ট্রেজারীর অস্ত্র বের করে আনতে চাইলেন। নড়াইলের এমসিএ খোন্দকার আব্দুল হাফিজ ,বিএম মতিয়ার রহমানসহ নেতৃবৃন্দ নুর মোহাম্মদ মিঞার প্রস্তাবে একমত হলেন। কিন্তু ট্রেজারীর চাবি এসডিপিও যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে। তিনি চাবি দিতে চাইলেন না। বরং উত্তেজিত বাক্য বিনিময় করলেন এবং গা ঢাকা দিলেন। অগত্যা তালা ভেঙ্গেই অস্ত্র বের করার সিদ্ধান্ত হলো। এমরান ভাই তাদের বাড়ি থেকে কুড়াল নিয়ে এলেন এবং গামা পাটনিসহ অন্যরা মিলে ট্রেজারীর তালা ভেঙ্গে ফেলা হলো। ২৬ মার্চ সকাল ১১ টার দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও মুক্তিকামী জনতা মিলে নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে সেখানে থাকা দুই শতাধিক রাইফেল ও চার বাক্স গুলি বের করে আনা হলো। কারো কারো মতে রাইফেলের সংখ্যা ২২৭ টি। রাইফেল ও গুলি নড়াইলের পরিবর্তে লোহাগড়ায় রাখা নিরাপদ মনে করে লোহাগড়ায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হলো। বিশেষ করে লোহাগড়ায় যেহেতু পূর্ব থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু রয়েছে তাই সকলে এ সিদ্ধান্তে একমত হলেন। তাছাড়া নড়াইলের কেউই তখন এভাবে আনা সরকারী অস্ত্র রাখতে রাজী হলেন না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার মাত্র ১০ ঘন্টার মাথায় নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে অস্ত্র লুট করে আনা মুক্তিযুদ্ধের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং দুঃসাহসিক কাজ বটে। তবে ওই গুলি ও সব কয়টা রাইফেল লোহাগড়ায় আনা যায়নি। নৌকা পারাপারের সময় কিছু রাইফেল ও গুলি তৎকালীন ইপিসিপি (এম এল) কর্মীরা নিয়ে যায়।

তবে ঘটনার তারিখ ও রাইফেলের সংখ্যা নিয়ে যশোরের খ্যাতিমান সাংবাদিক প্রয়াত শামসুর রহমান ১৯৮৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তার লেখা ‘৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায় ’ নামক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নড়াইল-লোহাগড়া এলাকায় পার্টি কর্মীদের ভুমিকা অংশে লিখেছেন, “২৭ মার্চ সকালে কয়েক হাজার লোক নড়াইল ট্রেজারীর ৩০০ আগ্নেয়াস্ত্র ও লক্ষাধিক রাউন্ড গুলি লুট করে। অস্ত্র লুটের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন যুক্ত থাকলেও ই পি সি পি (এম এল)এর কর্মী-সমর্থকরা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিঞা এবং নড়াইলের তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসক জনাব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী অস্ত্র লুটে জনগনকে সহায়তা দেন। ই পি সি পি (এম এল) এর পক্ষে সাইফ হাফিজুর রহমান ৫০ টি রাইফেল ও ১০ হাজার রাউন্ড গুলি নিজ সংগ্রহে রাখেন। অসহযোগ চলাকালে পার্টির সদস্যদের হাতে আসা এগুলিই প্রথম অস্ত্র ”।

নড়াইল থেকে আনা অস্ত্রগুলি লোহাগড়া হাইস্কুলে রাখা হলো। অস্ত্র আনার খবর শুনে বিকালে স্কুলে গেলাম। সে যেন রাইফেল ও গুলির প্রদর্শণী। আমি এর আগে একসাথে এত রাইফেল কখনো দেখিনি। লোহাগড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক শা ম আনয়ারুজ্জামানের উপর পড়লো রাইফেল ও গুলি সংরক্ষণের গুরু দায়িত্ব। লেখা চলবে। ( লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব)।