লিও তলস্তয়ের রাজা ও জুয়াড়ির গল্পঃ “খরচ বড় বেশি”

33
38

সাহিত্য- ছোটগল্প, লেখক- লিও তলস্তয় (গী দ্যা মপাসাঁর একটি গল্প অবলম্বনে)

ভূমধ্যসাগরের তীরে ফ্রান্স ও ইতালির সীমান্তের নিকটে মােনাকো নামে একটি অতি ক্ষুদ্র রাজ্য আছে। অনেক ছােট মফস্বল শহরই এই রাজ্যটির চাইতে বেশি জনসংখ্যার দাবি করা যেতে পারে, কারণ সেখানকার মােট জনসংখ্যা মাত্র সাত হাজারের মতাে, আর রাজ্যের সমস্ত জমি অধিবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দিলে প্রত্যেকের ভাগে এক একরও জুটবে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু সেই খেলনা রাজ্যেও একজন সত্যিকারের ক্ষুদে রাজা আছে, আছে রাজপ্রাসাদ, সভাসদবর্গ, সচিবগণ, বিশপ, সেনাপতি ও একটি সেনাবাহিনী।

সৈন্য দলটি বড় নয়, সৈন্যসংখ্যা মাত্র ষাট, তবু সেনাদল তাে বটে। অন্য সব জায়গার মতাে এখানেও আছে, নানারকম কর : তামাকের উপর কর, ম’দ্যজাতীয় পানীয়ের উপর কর, এবং মাথা গুণতি কর। যদিও অন্য সব দেশের মতােই সেখানকার লােকেরাও ম’দ ও ধুম’পান করে, তবু সেখানকার লােকসংখা এতই কম যে একটি নতুন ও বিশেষ ধরনের রাজস্বের ব্যবস্থা না করলে সভাসদ, কর্মচারী ও নিজের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা রাজার পক্ষে শক্ত হয়ে পড়ত। এই বিশেষ রাজস্ব আসে একটি জু’য়ার আডডা থেকে। সেখানে সকলে রুলে’ত খেলে। লােকে সেখানে জু’য়া খেলে; তারা হারুক বা জিতুক আডডার পরিচালকরা শতকরা হিসেবে একটা মুনাফা পায় আর সেই লভ্যাংশের একটা বড় অংশ সে রাজাকে দেয়। ইউরােপে এখন এটিই এ ধরনের একমাত্র জু’য়ার আডডা বলেই সেটা থেকে রাজা এত বেশি টাকা পেয়ে থাকে। কিছু কিছু ছােটখাট জার্মান নৃপতিরও এই ধরনের জু’য়ার আড্ডা ছিল, কিন্তু কয়েক বছর আগে সেগুলাে নি’ষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সব জু’য়ার আড্ডা অনেক ক্ষতি করত বলেই সেগুলাে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

একটি লােক হয়তাে এল, ভাগ্য পরীক্ষা করল, তার যা কিছু ছিল বা’জি ধরে সর্বস্ব হারাল, তারপর যে টাকা তার নিজস্ব নয় সেটা বা’জি ধরেও হেরে গেল, তার তারপর হতাশ হয়ে হয় নদীতে ডু’বে ম’রল, নয় তাে নিজেকেই গু’লি করে বসল। কাজেই শা’সকরা যাতে এ পথে টাকা উপার্জন করতে না পারে জার্মানরা সেই ব্যবস্থাই করল। কিন্তু মােনাকোর রাজাকে বাধা দেবার কেউ ছিল না, কাজেই এই একচেটিয়া ব্যবসাটা তার হাতেই রয়ে গেছে।

কাজেই এখন যারই জু’য়া খেলবার ইচ্ছা হয় সেই মােনাকোতে চলে যায়। তারা হারুক আর জিতুক, রাজা যথারীতি লাভবান হয়। প্রবাদ আছে, “সৎপথে পরিশ্রম করে কখনও পাথরের রাজপ্রাসাদ বানানাে যায় না।” মোনাকোর ক্ষুদে রাজা জানে যে কাজটা নােংরা, কিন্তু তাঁর উপায় কি? তাকে তো বাচতে হবে; ম’দ ও তা’মাক থেকে রাজস্ব আদায় করাও তাে ভালাে কাজ নয়। এই করেই তাে সে বেঁচে আছে, রাজত্ব করছে, টাকা উপার্জন করছে, এবং সত্যিকারের রাজার মতাে জাঁকজমকের সঙ্গেই দরবরে বসছে।

তার রাজ্যে অভিষেক হয় দরবার বসে: সেও পুরস্কার দেয়, দ’ণ্ড বিধান করে, ক্ষমাও করে; রাজকার্যের পর্যালােচনা ব্যবস্থা আছে, পরিষদ আছে, আইন আছে, বিচারালয় আছেঃ অন্য সব রাজরাজড়ার মতােই সবকিছু আছে, শুধু একটু ছােট মাপের এই যা তফাৎ।

এদিকে হলো কয়েক বছর আগে এই খেলনা রাজার রাজত্বে একটা খু’ন হলো। রাজ্যের অধিবাসীরা সকলেই শান্তিপ্রিয়; এ ধরনের ঘটনা সেখানে আগে কখনও ঘটেনি। রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকরা সমবেত হয়ে আইন অনুসারে বিচার করল। বিচারক এল, উকিল এল, জরি এল, ব্যারিস্টার এল। তারা অনেক ত’র্ক-বিত’র্ক করল, বিচার বিবেচনা করল এবং শেষ পর্যন্ত আইনের নির্দেশ মতাে অপরাধীর মু’ণ্ডচ্ছে’দের দ’ণ্ড বিধান করল। খুব ভালাে কথা। তারপর তার সেই দ’ণ্ডাজ্ঞা রাজার কাছে পাঠাল। রাজা দ’ণ্ডাদেশ পড়ে সমর্থন করল সবাই। “লােকটি প্রা’ণদ’ণ্ড যদি দিতেই হয় তা তাে দেয়া হােক।”

এ ব্যাপারে কিন্তু একটিমাত্র অসুবিধা দেখা দিল; তাদের না ছিল মু’ণ্ডু কাটবার মতো গিলো’টিন, আর না ছিল কোনাে জ’ল্লাদ। অনেক বিচার-বিবেচনা করে সচিবগণ স্থির করল, ফরাসি সরকারের কাছে এই মর্মে আবেদন করা হােক যে তারা অ’পরাধীর মু’ণ্ডুচ্ছেদ করবার মতাে একটা যন্ত্র ও একজন বিশেষজ্ঞকে ধার দিতে পারে কিনা, এবং পারলে তার দরূণ কত খরচ পড়বে দয়া করে সেটা জানান। চিঠি পাঠানাে হলাে। এক সপ্তাহ পরে জবাব এল: একটি যন্ত্র ও একজন বিশেষজ্ঞ পাঠানাে যেতে পারে আর সে জন্য খরচ পড়বে ১৬,০০০ ফ্রাঁ। জবাবটা রাজার সামনে পেশ করা হলাে। রাজা অনেক ভাবল। ষােল হাজার ফ্রাঁ। সে বলল, “হ’তভাগাটার দাম এত হতে পারে না। আরও সস্তায় কি কাজটা করা যায় না? আরে ১৬,০০০ ফ্রাঁ খরচ হলে তাে সারা দেশের জনপ্রতি দু ফ্রাঁর বেশি খরচ পড়বে। প্রজারা কিছুতেই তা সহ্য করবে না। ফলে একটা দা’ঙ্গা বেধে যেতে পারে।”

কাজেই এই অবস্থায় কি কর্তব্য স্থির করবার জন্য পরিষদকে ডাকা হলাে। সেখানে স্থির হলাে, ইতালির রাজার কাছে অনুরূপ আবেদন করা হােক। ফরাসি সরকার প্রজাতন্ত্রবাদী, কাজেই রাজাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়, কিন্তু ইতালির রাজা আর সহােদরপ্রতিম রাজা, কাজেই সে হয় তা সস্তায় কাজটা দিতে পারে। তাকে চিঠি লেখা হলো, আর চটপট জবাবও পাওয়া গেল।

ইতালিয় সরকার লিখে জানাল, আনন্দের সঙ্গেই তারা একটি যন্ত্র ও একজন বিশেষজ্ঞকে পাঠাবে, আর যাতায়াতসহ মােট খরচ পড়বে ১২,০০০ ফ্রাঁ। এটা অনেক সস্তা, কিন্তু তবু বড়ই বেশি। ঐ ব’দমাশটার জন এত টাকা খরচ করা চলে না। এর অর্থই দাড়াবে জনপ্রতি আরও প্রায় দু ফ্রাঁ করে কর বৃদ্ধি। আর একটি পরিষদ ডাকা হলাে । আরও কম খরচে কাজটা কি করে করা যায় তাই নিয়ে অনেকটা আলােচনা ও চিন্তা-ভাবনা করা হয়।

ধরা যাক, কেন একটি সৈন্যকে নিয়ে কি সদামাটাভাবে কাজটা করানাে যায় না? সেনাপতিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হলাে : “এই লােকটার মু’ণ্ডটা কে’টে ফেলতে পারে এমন একজন সৈনিক কি তুমি দিতে পার না? যু’দ্ধে তাে তারা অনেক লােক মেরে থাকে। আসলে, সেই কাজের জন্যই তাে তাদের তালিম দেয়া হয়। তখন সেনাপতি সৈনিকদের নিয়ে আলােচনায় বসল, তাদের মধ্যে কেউ এই কাজের ভার নিতে রাজি কি না সেটা জানতে। কিন্তু সৈন্যরা কেউ রাজি হলাে না। বলল, “না, এ কাজ কিভাবে করতে হয় তা আমরা জানি; এ ধরনের কাজ তাে আমাদের শেখানাে হয় নি।”

কি করা যায়? সচিবগণ আমার পুনর্বিবেচনায় বসল। তারা একটি কমিশন বসাল; পরে একটা কমিটি ও সাব-কমিটি বসাল, এবং শেষ পর্যন্ত স্থির করল মৃ’ত্যুদ’ণ্ড পরিবর্তন করে যাব’জ্জীবন কারা’দ’ণ্ডের ব্যবস্থা করাই শ্রেষ্ঠ পথ। এতে রাজা ক্ষমা প্রদর্শনও করতে পারবে, আর খরচও অনেক কম পড়বে। রাজাও এতে সম্মতি দিল এবং সেই মতাে ব্যবস্থাই করা হলাে। তখন একমাত্র অসুবিধা দেখা দিল, যাব’জ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত লােকের মতাে লােক কা’রাগারে ছিল না।

লোককদের সাময়িকভাবে আটক করে রাখবার মতাে একটা হাজত সেখানে ছিল, কিন্তু স্থায়ীভাবে বসবাস করবার মতাে শ’ক্তপােক্ত কোনাে কারাগার ছিল না। যা হোক, প্রয়ােজনীয় একটা জায়গা খুঁজে পেতে যুবকটিকে সেখান রেখে একজন রক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। অ’পরাধীকে পাহারা দেয়া এবং প্রাসাদের রানাঘর থেকে তার খাবার এনে দেয়াই রক্ষীর কাজ।

ব’ন্দি লােকটি মাসের পর মাস সেখানে কাটাতে লাগল। বছর পার হয়ে গেল। বছরান্তে ক্ষুদে রাজা একদিন বসে বসে আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা করতে করতে ব্যয়ের একটা নতুন দফা দেখতে পেল। সেটা হলাে সেই অ’পরাধীর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়, আর ব্যয়ের অংকটা খুব ছােটও নয়। একটি বিশেষ রক্ষী ও লােকটির আহারাদির ব্যয় বছরে ৬০০০ ফ্রাঁরও বেশি। ব্যাপারটা আরও শাে’চনীয় এই জন্য যে, লােকটি এখনও যুবক এবং আরও পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকতে পারে। সে সব হিসাব করলে তাে গুরুতর ব্যাপার হয়ে দাড়াবে। এত চলতে পারে না। সুতরাং, রাজা সচিবগণকে ডেকে বললঃ

এই ব’দমাশটার জন্য আরও সস্তায় কোন ব্যবস্থা তােমাদের করতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থাটা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। সচিবরা একত্র মিলিত হয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করল। শেষে একজন বলল, “ভদ্রজনরা, আমার মতে রক্ষীটাকে ব’রখাস্ত করা হােক।” তখন অন্য সচিব বলল, “কিন্তু তাহলে যে লােকটা পালিয়ে যাবে। প্রথম বক্তা বলল, “বেশ তাে, পালিয়ে গিয়ে ফাঁ’সিতে ঝু’লুক। ক্ষুদে রাজার কাছে গিয়ে তারা সব কথা নিবেদন করল, আর রাজাও তাদের কথায় সায় দিল। রক্ষীকে বরখাস্ত করা হলাে; তারপর কি ঘটে দেখবার জন্য তারা আপেক্ষা করতে লাগল। মােদ্দা এই ঘটল যে, দুপুরের খাওয়ার সময় বাইরে বেরিয়ে এসে রক্ষীকে দেখতে না পেয়ে বন্দি নিজেই খাবার আনতে রাজার রান্নাঘরে চলে গেল। যা পেল তাই নিয়ে কারাগারে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ভিতরে থেকে গেল। পরদিনও সেই একই ঘটনা ঘটল। যথাসময়ে সে খাবার আনতে গেল, কিন্তু পালিয়ে যাবার তিলমাত্র লক্ষণ ও তার মধ্যে দেখা গেল না। কি করা যায়? বিষয়টা নিয়ে তারা আবার ভাবতে বসল।

বলল, “ওকে সরাসরি বলে দিতে হবে যে তাকে আমরা রাখতে চাই না।” সেই অনুসারে বিচারবিভাগীয় মন্ত্রী তাকে ডেকে পাঠালো। “তুমি কেন পালিয়ে যাচ্ছ না? তােমাকে রাখবার মতাে রক্ষী আমাদের নেই। তুমি যেখানে খুশি যেতে পার; তাতে রাজা কিছু মনে করবেন না।”

লােকটি জবাব দিল, “রাজা যে কিছু মনে করবেন না তা আমিও ভালােই জানি, কিন্তু আমার যে যাবার জায়গা নেই। আমি কি করতে পারি? দ’ণ্ড দিয়ে আপনারা আমার চ’রিত্র ন’ষ্ট করেছেন; লােকে আমাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাছাড়া, আমার কাজকর্মের অভ্যাসও চলে গেছে। আপনারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। এটা ঠিক না। প্রথমত, একবার যখন আমরা আমার প্রা’ণদণ্ড দিয়েছিলেন তখন সে দ’ণ্ডাদেশ কার্যকরী করাই আপনাদের উচিত ছিল, কিন্তু তা আপনারা করেন নি। এই হলাে এক দিক। তা নিয়ে আমি কোনাে অভিযােগ করি নি। তারপর আমাকে আজীবন কারাদ’ণ্ড দ’ণ্ডিত করে আমার খাবার এনে দেবার জন্য একটি রক্ষী মােতায়েন করলেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই তাকে সরিয়ে দিলেন, আর আমাকেই আমার খাবার আনতে হতাে। তবু আমি কোনাে নালিশ জানাই নি। কিন্তু এখন আপনারা আমাকে সত্যি সত্যি চলে যেতে বলছেন! এ তাে আমি মেনে নিতে না। আপনারা যা খুশি তাই করতে পারেন, কিন্তু আমি এখন থেকে যাব না।”

কি করা যায়? আবার পরিষদকে ডাকা হলাে। তারা কি করবে? লােকটা তাে যাবে না। তারা অনেক ভাবল, অনেক চিন্তা করল। তার হাতে থেকে রেহাই পাবার একমাত্র উপায় তার জন্য একটা অবসরকালীন বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেয়া। রাজাকে সেই প্রস্তাবই তারা বলল, “এ বিষয়ে আর কিছু করার নেই। যেমন করেই হােক ওর হাত থেকে রেহাই পেতে হবে।” ৬০০ ফ্রাঁ পেন্সন ধার্য হলাে, এবং সেটা বন্দিকে জানিয়ে দেয়া হলাে

সে বলল, “ঠিক আছে। আপনারা যতদিন টাকাটা নিয়মিতভাবে দেবেন ততদিন আমি কিছু বলব না। এই শর্তে আমি চলে যেতে রাজি আছি।” এইভাবে ফয়সালা হয়ে গেল। বার্ষিক বৃত্তির এক-তৃতীয়াংশ অগ্রিম নিয়ে লােকটি সেই রাজার রাজত্ব ছেড়ে চলে গেল। জেলপথে মাত্র পনেরাে মিনিটের পথ; রাজ্য ছেড়ে ঠিক তার সীমান্ত পার হয়েই সে একখণ্ড জমি কিনল, সজিবাগান করল এবং বেশ আরামেই বাস করতে লাগল। যথাসময়ে গিয়ে বৃত্তিটা নিয়ে আসে। সেটা পেয়েই জুয়ার টেবিলে যায়, দুই বা তিন ফ্রাঁ বাজি ধরে, কখনও জেতে আবার কখনও হারে, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। সে বেশ সুখে-শান্তিতেই আছে। (অনুবাদঃ অধ্যাপক মণীন্দ্র দত্ত)