নড়াইলের কালিয়ায় যোগানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম!

2
555

স্টাফ রিপোর্টার

দুপুরে শিক্ষকদের রান্নার গ্যাস বিল দেয় ছাত্ররা। পরীক্ষার সময় নানা অজুহাতে অতিরিক্ত টাকা আদায়, স্কুলের গাছ কেটে বাড়ির ফার্নিচার, চেক জালিয়াতি, উপবৃত্তির অনিয়ম এসবই নিয়মে পরিনত করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্কুল কমিটি। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করিয়ে কয়েক গুন টাকা নিয়ে ফরম পূরণ, শিক্ষকদের দুপুরের রান্নার গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল দেয় ছাত্ররা। ছাত্র-ছাত্রীদের টাকার মাধ্যমে উপবৃত্তি, এমনকি পাশ করা ছাত্রদের প্রশংসাপত্র নিতে দিতে হয় দু’শ টাকায়। এ সবই চলছে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার যোগানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

অভিযোগে উঠে আসে টানা ২২ বছর ধরে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে নানা অনিয়মের মাধ্যমে টাকা আদায় করে আসছেন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এস এম আলমগীর হোসেন। শুধু সহকারী প্রধান শিক্ষকই নয়, স্কুলের গাছ কেটে ভাগবাটোয়ারা, স্কুলের নামে অন্যের জমি দখলের পায়তারা করছে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সহ প্রভাবশালী দুই সদস্য। অত্যাচারে নিজের জমি হারানোর আশংকায় দিন কাটছে ৭০ বছরের সুখরঞ্জন সিকদারের পরিবার। তার জায়গা থেকে কয়েকটি গাছ কেটে নিয়ে গেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভয়ে মুখ খুলতে না পেরে কষ্টে ৩ দিন না খেয়ে কাটিয়েছেন এই পরিবারটি। স্থানীয়দের অভিযোগ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহাবুবুল আলমের ছত্রছায়াতেই ঘটছে এসব।

সরেজমিন অভিযুক্ত বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে। সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আব্বাস আলী খান ও মিনহাজুর রহমান বসে আসেন। সাংবাদিক পরিচয়ে আব্বাস আলী তেড়ে এসে বলেন সাংবাদিক এসে কি করবে, এর আগে কত সাংবাদিক আসলো, এটা স্কুলের ব্যাপার আমরা ম্যানেজিং কমিটি যা ঠিক করবে তাই হবে। এক পর্যায়ে স্থানীয় এমপির খুব কাছের লোক পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদন না করার জন্য হুমকী দেন তিনি।

স্থানীয়রা জানায়, ২০০৫ সালে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক মিয়ার সই জাল করে বিদ্যালয়ের দেড় লক্ষ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেয় সহকারী প্রধান শিক্ষক আলমগীর। এসময় আলমগীরের বাবা ছিলেন বিদ্যালয়ের সভাপতি। জানা যায়, এই অপবাদ সহ্য করতে না পেরে ওই প্রধান শিক্ষক স্ট্রোক করে মারা যান। এ ঘটনায় আলমগীর কিছুদিন জেল খেটে বের হয়ে আসেন। এরপর থেকে আলমগীর শুরু করেন শিক্ষা বাণিজ্য। সম্প্রতি গত কয়েক বছর আগে বিদ্যালয়ের নির্বাচনে বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি মাহাবুবুল আলম জয়লাভ করার ফলে বিপুল ক্ষমতার মালিক বনে যান সহকারী প্রধান শিক্ষক আলমগীর।

২০১৯ সালের এসএস সি পরীক্ষায় মোট ১’শ ৩৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। স্কুলের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অভিযোগ, নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১’শ ২৩ জনের মধ্যে ১’শ ৬ জনকেই এস এস সি নির্বাচনী পরীক্ষায় বিভিন্নভাবে অকৃতকার্য দেখানো হয়। এইসব অকৃতকার্যদের কারো এক আবার কারো ৪ বিষয়ে ফেল দেখিয়ে তাদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ৪ হাজার ১’শ টাকা করে দিতে বাধ্য করে স্কুল কর্তৃপক্ষ,যার মূল হোতা সহকারী প্রধান শিক্ষক আলমগীর। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবীকৃত টাকা প্রদান করেও এসএসসি পরীক্ষায় অংশই নিতে পারেনি।

২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী রানা শেখ জানায়, চার হাজার টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করেও আমার প্রবেশ পত্র আসেনি যার কারণে আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারেনি। আমার অপরাধ সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাছে স্যারের কাছে ফরম পূরনে বেশি টাকার হিসাব চেয়েছিলাম। সদ্য পাশ করা ছাত্র শাহিদ সিকদার জানান, এসএসসি টেষ্ট পরীক্ষায় আমাকে ৩ বিষয়ে ফেল করায়। চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য ফরম পুরণে চার হাজার একশ টাকা নেয়। চর যোগানিয়া গ্রামের আরিফ, তাছলিমা খানম, পুকুরিয়া গ্রামের মারিয়া খানম, ডুমুরিয়া গ্রামের গনিমিয়া সহ অন্ততঃ২০ জন ছাতের সাথে কথা বলে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্কুলের পাশের একজন অভিভাবক নুরজাহান বেগম জানান, আমার ছেলে রমজান আলীকে এসএসসির টেষ্ট পরীক্ষার ৪ বিষয়ে ফেল করায়ে ফরম পূরণের সময় ৪ হাজার টাকা নিয়েছে, অথচ আমার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় পাঁচ বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে পাশ করেছে। মেয়ে নিলমা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েকে উপবৃত্তি দেবার কথা বলে দুই দফায় ৪’শ টাকা নিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় আমার মেয়ের বেতন ও পরীক্ষার ফি সবই দিতে হয়েছে। এই স্কুলে কোন নিয়মই মানা হয়না।

২০১৯ সালে এসএসসি পাশ করা ছাত্র শাহিন হোসেন জানান, কলেজে ভর্তি হবার জন্য প্রংশসাপত্র নিতে আসলে ২’শ টাকা চেয়েছেন আলমগীর স্যার,টাকা না দিলে আমার প্রংশসাপত্র দেয়া হবে বলে সাফ দিয়েছিলেন।পরে বাধ্য হয়ে প্রত্যেকে টাকা দিয়ে প্রশংসা পত্র নিচ্ছে। স্কুলের ৬ষ্ট থেকে দশম শ্রেনীর অন্ততঃ ১০ জন ছাত্রের সাথে কথা বললে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্যাররা দুপুের গ্যাসে রান্না করেন এই বাবদে ৫ টাকা এবং বিদ্যুৎ বিল সহ মোট ১০ টাকা নেয়া হয় বেতনের সাথে।

খোজ নিয়ে জানা গেছে,স্কুলের উন্নয়নের নামে স্কুলের জমি থেকে নিয়মিত গাছ কেটে নেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। স্কুলের জমি থেকে নানা সময়ে কয়েক লক্ষ টাকা গাছ কেটে নিজের বাড়ির ফার্নিচার বানিয়েছেন বর্তমান সভাপতি মাহাবুুবুল আলম। নড়াগাতি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালিন নির্বাচনে জোর পূর্বক সভাপতি নির্বাচিত হয়ে স্কুলের সম্পদ ধ্বংসের পায়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক এর মাধ্যমে। এদের ভয়ে অভিভাবক এমনকি অন্য সদস্যরাও কথা বলতে পারেন না।

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দাতা সদস্য আমীর আলী জানান, ভবন সংস্কারের নামে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন, বেঞ্চ ও চেয়ার তৈরীর নামে বিদ্যালয়ের জমিতে থাকা বড় বড় গাছ বিক্রি করে পরিচালনা কমিটির সদস্যরা ও সহকারি প্রধান শিক্ষক ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। আমি কিছু বলতে গেলে ভয় দেখায়। আমার অনুপস্থিতিতে সভার রেজুলেশনে আমার স্বাক্ষর জাল করেছে মাহাবুব আর আলমগীর। আপনার চলে গেলে আমাকে ওরা মারতে পারে।

স্কুলের পাশের বাসিন্দা সুখরঞ্জন শিকদার (৭০) জানান, আমার জমিতে লাগানো ২টি মেহগনি গাছ কেটে নিয়ে গেছে আব্বাস আলী খান ও মিনহাজুর রহমান। আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে আমার কোন কথাই তারা শোনেনি। এখন তারা সব গাছ কেটে নেবার এবং আমার ওই জমি দখলের পায়তারা চালাচ্ছে। কিছু বলতে গেলে হুমকি দিচ্ছে।

নড়াগাতি থানা ছাত্রলীগ সভাপতি কে এম লালিফ হোসেন বলেন, নড়াগাতী থানা ছাত্রলগীগের পদ ভাঙ্গিয়ে মাহাবুবুল আলম ২০১৭ সালে যোগানিয়া ডি এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়। এসময় স্কুলের ২০ টি গাছ এবং নড়াগাতী খাল পাড়ের গাছ জবরদখল করে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার গাছ বিক্রি করেছে, বাড়ির আসবাপত্র তৈরি করেছে।

অভিযোগ বিষয়ে পরিচালনা কমিটির সদস্য আব্বাস আলী খান বলেন, বিদ্যালয়ে কোন অনিয়ম হয়না। আমারা যে গাছ বিক্রি করেছি ওই জমি বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য আব্দুল মমিন শেখ দান করে গেছে। তাছাড়া ওই গাছ দিয়ে আমরা বিদ্যালয়ের একটি ভবন সংষ্কার করেছি এবং বেঞ্চ তৈরি করেছি।

বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক এস এম আলমগীর হোসেন অতিরিক্ত অর্থ আদায় সহ অন্যান্য ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রশংসা পত্রের জন্য দু’শ টাকা ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস বাবাদ ১০ টাকা করে কেন নেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, গ্যাসের বিল নেয়া হয়না তবে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৫ টাকা করে নেয়া হয়। তবে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে টাকা আদায় এবং উপবৃত্তির ব্যাপারে ভালো উত্তর দিতে পারেননি অভিযুক্ত এই শিক্ষক।

অভিযোগ বিষয়ে যোগানিয়া ডি এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহাবুবুল আলম বলেন, স্কুলে অনেক আগ থেকে দুটি পক্ষ বিরাজমান, আমি সভাপতি হবার পরে এখন শিক্ষকদের মধ্যে কোন দলাদলি নাই। আপনার কাছে যে সকল অভিযোগ এসেছে এগুলো সবই প্রতিপক্ষের। তবে গাছকেটে নেবার কোন ব্যাখ্যাই দেননি প্রভাবশালী এই নেতা। যোগানিয়া স্কুলের শিক্ষা বাণিজ্য এবং অনিয়ম প্রসঙ্গে নড়াইল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম সায়েদুর রহমান বলেন, বিদ্যালয়ের ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে,কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।