লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ পাকসেনা কর্তৃক লোহাগড়া অভিযানের প্রথম দিনে লুট ও হত্যা

0
6
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ- পুনরায় যশোর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

নড়াইল শহর দখলের অন্ততঃ ১৫ দিন পর পাক আর্মিরা লোহাগড়ায় অভিযান চালায়। পাকসেনারা এক রকম বিনা বাধায় সড়ক পথে লোহাগড়ায় চলে আসে। ওরা থানা সদর অর্থ্যাৎ লক্ষিপাশা এসে ওদের দালাল ও সহযোগি পিস কমিটির নেতাদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে তাদের ভাষায় ‘মালাউনদের শায়েস্তা’ করতে। পাকসেনাদের বৃহৎ দলটি অভিযান চালায় লোহাগড়া বাজারে।

লক্ষ্মীপাশায় পাক আর্মি এসেছে শুনেই বাজারের দোকানদাররা মুহুর্তের মধ্যেই দোকান-পাট বন্ধ করে যে যেদিক পারে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা তাদের দালালদের নিয়ে নদী পার হয়ে বাজারে এসে ওদের দ্বারা বাজারের বড় বড় দোকানগুলি লুঠ করিয়ে দেয় এবং লুঠতরাজের ছবি তুলে নেয়। ওরা এমনভাবে ছবি তোলে যেন বাঙ্গালীরা লুঠপাঠ করছে এবং ওরা যেন তা প্রাণপণ ঠেকাচ্ছে। পাক আর্মির সাথে থাকা পিস কমিটির নেতারা হিন্দুদের বড় বড় দোকানগুলি দেখিয়ে দেয়। ওরা দোকান গুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।ওদের সাথে থাকা লুটেরা দোকানের মালামাল লুঠ করে নেয়। পাক সেনারা লুঠপাটে সাহায্য করে। দালাল-লুটেরা হিন্দুদের দোকান লুটের কথা বলে লুটপাট শুরু করলেও মুসলমানদের অনেক দোকান লুট করে নিয়ে যায়। লুটপাটকারীরা বেশ মজা করে বাজারের মিষ্টির দোকানগুলি লুট করে।

পাকসেনারা বাজারের তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় দোকানগুলির অন্যতম জগবন্ধু সাহা ও চিত্তরায়ের কাপড়ের দোকান ,বৈদ্যনাথ সাহার মুদি দোকান এবং অজয় মজুমদারের ঔষধের দোকান পুড়িয়ে দেয়। পাউডার জাতীয় দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় মুহুর্তের মধ্যেই আগুনে ভষ্মিভুত হয়ে যায় পাশাপাশি থাকা বৃহৎ এই দোকানগুলি।

তৎকালীন সময়ের এতদাঞ্চলের বৃহৎ এই বাজারটি মুহুর্তের মধ্যেই শ্মশাণে পরিণত হয়। পাকসেনারা সেদিন মানুষ মারতে তৎপর না হলেও তৎকালীন গরু হাটের কাছে কুড়াল কাঁধে মহিশাহপাড়ার নুরো মুছল্লীকে দেখে তাকে গুলি করে হত্যা করে। সে ওই সময়ে গরু হাটের কাছে কাঠের চলা ফাঁড়ার কাজ করছিল। পাকসেনাদের দেখে অন্যদের সাথে সেও পালিয়ে যাচ্ছিল। তার কাঁধে কুড়াল দেখে ওরা হয়তো ভেবেছিল লোকটা রাইফেল কাঁধে মুক্তিবাহিনীর লোক।
পাকসেনাদের একটি দল লোহাগড়া কলেজে অভিযান চালায়।

আর্মিদের কাছে লোহাগড়া কলেজে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পের খবর আগেই পৌছে দেয়া হয়েছিল। তবে ট্রেনিং ক্যাম্প আগেই ভেঙ্গে দেয়ায় ওরা কলেজে গিয়ে এর কোন প্রমান পায়নি। লোহাগড়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান তার লোহাগড়া মুক্তিযুদ্ধ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘পাকমিলিটারী এসে লোহাগড়া বাজারে হানা দেয়। দোকানের মালপত্র লুট করায়। লুটকারীরা যখন লুটের মাল মাথায় করে দৌড়াতে থাকে, তখন ওরা ভিডিওতে তাদের ছবি নেয়। ওরা কলেজে গিয়েছিল। আমি তখন কলেজের অধ্যক্ষ। আমার কক্ষে কায়েদে আজমের ছবি টানানো ছিল। তাই বোধ হয় কলেজটি রক্ষা পেয়েছিল। না হলে কলেজের রক্ষা পাওয়ার কথা নয়।’

এদিকে পাকসেনাদের অপর একটি দল লক্ষিপাশা থেকে লঞ্চে করে কুন্দশী আসে। কুন্দশী তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই গ্রামের তথা গ্রামবাসীদের অনেক স্মৃতি বিজড়িত। নবগঙ্গা নদীর পশ্চিম পারে থানা সদর এবং পূর্ব পারে কুন্দশী গ্রাম। তার উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বসবাস। তাছাড়া অধিকাংশ সময় এই গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা থানার রাজাকার-পুলিশদের গতিবিধি ‘ওয়াচ’ করতো এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাতো। এপার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গুলি করলে রাজাকাররা অন্ততঃ দশটি গুলি ফুটাতো।

সঙ্গত কারনেই পাকসেনাদের দোসর পিস কমিটি ও তাদের অনুগত পুলিশ বাহিনির সদা নজর থাকতো এই গ্রামের দিকে। একারণে পাক আর্মিরা যেদিন প্রথমে লোহাগড়া আসে সে দিনে অবশ্যই কুন্দশী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসিদের শায়েস্তা করতে অভিযান চালাবে এটাই স্বাভাবিক। পাকসেনাদের দলটি লঞ্চে এসে কুন্দশী জেলে পাড়ার তমালতলায় নেমে গ্রামের মধ্য দিয়ে জেলেপাড়ার পূর্বদিকের মাঠ বেড় দিয়ে আমাদের (লেখকের) বাড়ির পূর্বদিক দিয়ে আমাদের উঠানে হাজির হয়। বাড়িতে তখন আমার বৃদ্ধ দাদী ছাড়া আর সবাই পালিয়ে গেছে।

আর্মিরা বাড়িতে কোন লোকজন না দেখে আমার দাদীকে বলে ‘এই বুইড্ডা ডর নেহি লোক কাহা -লোক ডাক’। আর্মিরা আমাদের বাড়ির পর দিয়ে প্রতিবেশী ডাঃ মহিউদ্দিনের বাড়িতে যায়। সেখানে তারা কিছুক্ষন অপেক্ষা করে। এদিকে লোহাগড়ায় পাক আর্মিদের আসার কথা শুনে গ্রামের লোকজন দিক-বিদিক ছুটে পালাতে থাকে। এ সময় আমি কিষানের সাথে মাঠে ছিলাম। গ্রামবাসিদের পালাতে দেখে তাদের সাথে আমিও পালাতে উদ্যেগ নেই।

কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো বাড়িতে আমার পোষা দু‘টি খাসি ছাগলের কথা। কারণ আগেই শুনে ছিলাম আর্মিরা পছন্দসই খাসি দেখলে ধরে নিয়ে যায়। আমি তখন দ্রুত বাড়ি ফিরে খাসি ছাগল দু‘টিকে লুকিয়ে রাখার উদ্দেশে বাড়ির পাশে জঙ্গলের মধ্যে বেঁধে রাখতে যাই। ততক্ষণে পাক আর্মিরা কাছাকাছি এসে পড়ায় দ্রুত খাসি দু‘টিকে যেনতেন করে বেঁধে রেখে এক দৌড়ে মঙ্গলহাটার মজিবরদের বাড়ির পাশে বাগানের মধ্যে গিয়ে গ্রামবাসিদের সাথে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি।

কিছুক্ষন পর দেখি আতোষপাড়ার ইনজাহের মিয়া টুপি মাথায় রাস্তা দিয়ে তার বাড়ির দিকে হেটে যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ইনজাহের মিয়ার কাছ থেকে জানলাম আর্মিরা তাকে কিছু বলেনি।ওরা এখন ডাঃ মহিউদ্দিনের বাড়িতে বসে আছে।

উল্লেখ্য ডাঃ মহিউদ্দিন পাক সমর্থক ছিলেন। পূর্ব থেকে আর্মি দেখার কৌতুহল থাকায় আমি ওই বাড়ির দিকে যেতে চাইলে উপস্থিত সবাই আমাকে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল ডাঃ মহিউদ্দিন আমার নিকট প্রতিবেশি। তিনি যেহেতু পাক সমর্থক তাই তার সামনে আর্মিরা আমাকে কিছু বলবে না। আর সে বিশ্বাস নিয়ে আমি ওই বাড়ির দিকে গেলাম।ওই বাড়িতে গিয়ে দেখি আর্মিরা ওই বাড়ির উঠানে এদিক-সেদিক মুখ দিয়ে বসে আছে। তাদের সাথে ডাঃ মহিউদ্দিন ও লক্ষিপাশার খালেদ ভাই (প্রথম জীবনে ডিসি অফিসের ক্লার্ক এবং পরে একটি বেসরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ হয়েছিলেন) । তারা একজন বৃদ্ধকে ডাব পাড়তে গাছে উঠিয়েছে। বৃদ্ধ প্রাণপণ চেষ্টা করে গাছে উঠছে।

ভাবলাম একটু আগে আসলে আমারই হয়তো ওই গাছে উঠতে হতো। ডাব খেয়ে আর্মিরা ফিরে যাবার সময় ডাঃ মহিউদ্দিনকে সাথে নিয়ে যেতে দেখে তার ছেলে বাবলু ও ভাতিজা ওলিয়ার কান্নাকাটি করতে করতে পিছু হাঠতে থাকে। ওদের ধারনা ওনাকে বোধ হয় আর্মিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও ওদের পিছু নেই। পঞ্চানন রায়ের বাড়ির সামনে গিয়ে আর্মিরা থেমে যায়। ওই বাড়ির সামনে একটি বড় পাকিস্তানি পতাকা টানানো দেখে পাক ক্যাপটেন বাড়ির মালিকের নাম জানতে চায়। তখন খালেদ ভাই মালিকের নাম পাচু রায় বললে পাক ক্যাপটেন নিশ্চিত হতে পুনরায় ডাঃ মহিউদ্দিনের কাছে জিজ্ঞাসা করে।

ডাঃ মহিউদ্দিন বললেন ওটা পাচু মোল্লার বাড়ি। পিস কমিটির দুই নেতা দুই রকম বলায় পাক ক্যাপটেন আরো নিশ্চিত হতে পিছনে থাকা আমাদের কাছে জানতে চাইলে আমরা ডাঃ মহিউদ্দিনের কথা শুনে সেইমত বলে দিলাম। আর্মিরা কুন্দশী তিনরাস্তা মোড়ে পৌছালে পাশের বাড়ি থেকে বিশাল দাড়ি মুখে টুপি মাথায় এবং বড় পাঞ্জাবি গায়ে জব্বার মিয়া (রাজমিস্ত্রি) দ্রুত এগিয়ে এসে বড় করে আছ্ছালামু আলাইকুম দিতেই ক্যাপটেন সাহেব একই আওয়াজে ওয়া আলাইকুম আছ্ছালাম বলে তার সাথে হাত মিলালেন।

পাক আর্মিরা সম্ভবতঃ পূর্ব থেকে জেনে এসেছিল তাদের লঞ্চ রাখা এলাকাটি হিন্দু পাড়া। তাই সেখানে পৌছে ক্যাপটেন সাহেব ডাঃ মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে জানতে চাইলেন এরা ‘মালাউন’ কি-না ? তখন মহিউদ্দিন সাহেব পাক ক্যাপ্টেনকে ইংরাজিতে বললেন,‘দে আর মালাউন, বাট দে আর নট পলিটিক্যাল পারসন। অল অফ দেম আর ফিসারম্যান। দে লিভস্ হ্যান্ড টু মাউথ’। ক্যাপটেন সাহেব থ্যান্ক ইউ বলে ডাঃ মহিউদ্দিন ও খালেদ সাহেবকে নিয়ে লঞ্চে উঠে আমাদের বললেন ‘তোম লোক বাজারমে যাও’। কিন্তু আমরা সে সময় ওরা কেন আমাদের বাজারে যেতে বললো তা বুঝিনি। তবে বাজার লুঠের কথা শুনে পরে বুঝেছিলাম। লেখা চলবে- (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব)