আমার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-বিজড়িত মধুমতি নদীর জয়বাংলা বাওড়

431
64

গুলশান আরা শেফালী

লোহাগড়া উপজেলার পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ইতনা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ছয়টি ছোট-বড় গ্রাম ঘিরে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা মধুমতি নদী গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে সৃষ্ট বাওড়টিকে ‘জয়বাংলার বাওড়’ বলা হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাওড়টি সৃষ্টি হয় বলে এমন নামকরণ। বাওড়টি আজও সে নামেই পরিচিত। জয়বাংলা নামক এই বাওড়টির দৈর্ঘ্য অন্ততঃ ১০ কিলোমিটার বা তার বেশি হবে। এই বাওড় সৃষ্টির ফলে ইতনা ইউনিয়নের উত্তর পাংখারচর, উত্তর লংকারচর, চর সুচাইল, চরপাচাইল ,চরপরাণপুর ও চর ঘোনাপাড়া নামক ছয়টি গ্রাম উপজেলার মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বলতে গেলে গ্রামগুলি আজও যেন সে অবস্থায়ই রয়ে গেছে। মূল ভুখন্ড থেকে যাতায়াতের সোজা বা সহজ কোন রাস্তা নেই বললেই চলে। আইন-শৃংখলা সহ জরুরি কোন প্রয়োজনে প্রশাসন বা ব্যক্তিগত কোন যানবাহনকে ওই ভুখন্ডে যেতে হলে কালনাঘাট পার হয়ে কাশিয়ানী উপজেলার মধ্য দিয়ে তবেই যেতে হয়।

মধুমতি নদী সৃষ্ট এই বাওড়ের পাড়ে অবস্থিত চর সুচাইল (ডাক নাম পাংখারচর) গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। আমার দাদা কৃষক হলেও আমার বাবা মোশার্রফ হোসেন তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের মেধাবী ছাত্র। আমার জন্মের আগে তিনি বি এল কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স পাশ করে কাশিয়ানী উপজেলার রাতইল হাই স্কুলে এবং ফুকরা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

আমাদের বাড়িটি তখন প্রমত্তা মধুমতি নদীর একেবারেই পাড়ে ছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরে আমাদের বাড়িটি ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়। আমার দাদীর কাছ থেকে শুনেছি- ওই সময়ে আমাদের বাড়িটি ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হলে ঘরবাড়ি সরানোর জন্য মিস্ত্রি ঠিক করা হয়। পরদিন সকালে মিস্ত্রি এসে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে অন্যত্র নিয়ে যাবে। কিন্তু সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখে নদীর স্রোত ও পানির তোড় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ্য ওই রাতে মধুমতি নদী আমাদের গ্রামের পাশ্ববর্তী লংকারচর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে ভেঙ্গে গতিপথ পরিবর্তন করে বাক সোজা করে মূল স্রোতের সাথে মিশে যায়। এতে আমাদের গ্রাম সহ ৬ টি গ্রাম নদীর পূর্ব পার্শ্বে পড়ে যায়। মধূমতি নদীর এই গতিপথ পরিবর্তনের ফলে নদীর সাবেক এলাকাটিতে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিরাট বাওড়ের সৃষ্টি হয়। যা ওই সময়ে ‘জয়বাংলার বাওড়’ নামে পরিচিতি পায়। বাওড়টি আজও সেই নামেই পরিচিত।

শরীফ আব্দুল হাকিম তার ‘নড়াইল জেলার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে মধুমতি নদী গতি পরিবর্তন করার ফলে ইতনা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে একটি বিরাট বাওড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই বাওড় জয়বাংলার বাওড় নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই বাওড় এখন প্রচুর মাছের আবাসস্থল’। আমাদের বাড়িটি সেই জয়বাংলা বাওড়ের পাড়ে আজও আছে। আমার শৈশব ও কৈশোরকালের অধিকাংশ সময় এ বাড়িতেই কেটেছে। আমার বাবা লেখাপড়া শেষ করে খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার নর্থ খুলনা ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। আমার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হবার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। বাবার কর্মস্থল তেরখাদা উপজেলা সদরে হওয়ায় আমি মাকে ছেড়ে বাবার কাছে তেরখাদা প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করি। কিন্তু বাওড় বেষ্টিত দুর্গম সেই গ্রাম ছেড়ে আমার স্থায়ীভাবে বেশিদিন তেরখাদা থাকা হয়নি। কখনও তেরখাদা আবার কখনও গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে।

জয়বাংলা পাড়ের গ্রামটিকে যেন আমি ছেড়ে যেতে পারিনি। আমি ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত তেরখাদা স্কুলে আবার ফোর-ফাইভ পাংখারচর স্কুলে পড়েছি। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আবার চলে যাই তেরখাদা। কিন্তু সেখান থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পাশ করে আবার চলে আসি পাংখারচর গ্রামে। কিন্তু আমাদের গ্রামে কোন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় বাওড়ের দক্ষিন পাড়ের তারাইল স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হই। মধুমতি নদী তখনও বাওড় বা মরানদী হলেও নদীর প্রশস্ততা তখনও আগের মতই ছিল। বর্ষাকালে নদী পার হওয়া বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল। নদীপার হতে গিয়ে কোন কোন দিন ভিজে গেছি। ফলে অনেক দিন স্কুল করা হয়নি। বাধ্য হয়ে আবার চলে যাই তেরখাদা। সেখানে ৮ম শ্রেণি পাশ করে আবার গ্রামে চলে আসি। তবে এবার ভর্তি হই বাওড়ের উত্তর পাড়ের রাতইল নায়েবুন্নেছা হাইস্কুলে। কিন্তু এখানেও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না। ভ্যান-রিকশার তো প্রশ্নই ওঠে না। পুরোপুরি পদব্রজে চার ক্রোশ। বাওড় পার হতে কিছু অংশ বাঁশের সাঁকো (গ্রাম্য ভাষায় চার বলা হয়) পার হতে হতো।

আমি ভালভাবে চার পার হতে পারতাম না। অনেক দিন চার পার হতে গিয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছি। আবার কোন কোন দিন স্কুলে না যাবার অজুহাতে ইচ্ছা করে পানিতে পড়ে ভিজে গিয়ে বাড়ি ফিরে চলে এসেছি। শীতকালে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। এভাবেই বাওড় জীবনের স্মৃতি বিজড়িত আমার এসএসসি পাস। এরপর আবার চলে যাই তেরখাদা। এবারও মাকে গ্রামে বৃদ্ধ দাদা-দাদীর সেবায় বাড়িতে রেখে ছোট তিন ভাইকে নিয়ে তেরখাদা যাই।

আমার বাবা আমাদের মা-বাবা দু‘জনেরই স্নেহ-মমতা দিয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সেখান থেকে এইচ এস সি ও ডিগ্রি পাস করে বিএল কলেজে এমএ ক্লাসে ভর্তি হই। কিন্তু এম এ পাস করার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসার ডাক আসে। ছোট ভাইদের বাবার কাছে রেখে চলে আসি স্বামীর বাড়িতে। আমার স্বামী আবদুস ছালাম খান একজন আইনজীবী হওয়ায় আমি চাকুরি খোঁজার পরিবর্তে সন্তানদের মানুষ করার কাজে সময় দিয়েছি বেশি। তারপরও এক ফাঁকে ডি এইচ এম এস ডিগ্রিটা নিয়ে রেখেছি। জীবনের অধিকাংশ সময়ই মা ছাড়া থেকেও আমার তিনটি ভাই এমএ পাস করে নিজ অবস্থানে সফলতা অর্জন করেছে। এদিকে আমিও মেধাবী তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তান নিয়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছি। দুর্গম বাওড়ের প্রতিকুলতা এবং মা ছাড়া থাকাসহ অপর কোন প্রতিকুলতা মানুষের শিক্ষা গ্রহনে বাঁধা হতে পারে না। আমাদের বাবা তাঁর জীবনের সফলতা দেখেই প্রয়াত হয়েছেন। মহান আল্লাহ আমার বাবাকে বেহেশ্ত নসীব করুন।

জয়বাংলা বাওড় পাড়ে আমার কৈশোর, শৈশব ও যৌবনের মূল্যবান সময় কাটানোর স্মৃতি ভোলার নয়। আমার জীবনের সাথে মিশে থাকা এই জয়বাংলা বাওড় আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে। # লেখিকা গৃহিণী