শুধু পাঠ্য পুস্তক ভিত্তিক পাঠদান বা পারিবারিক শিক্ষা ব্যক্তিকে আদর্শ ব্যক্তি রূপে গড়ে তোলে না

0
150
গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা
গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাঃ মুখবন্ধ

মীর আব্দুল গণি
জার্মানি প্রবাসী
e mail: [email protected]

আমরা সবাই স্পষ্ট উপলব্ধি করছি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাদানব্যবস্থায় শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষার্জন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু কেনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষার্জন সম্ভব হচ্ছে না তার কারণ জানতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্গত তথা শিক্ষাদানব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নিয়ে অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজন। উক্ত কারণেই প্রকাশিত ‘‘গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা‘‘ বইটির ভূমিকা তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন।

ভূমিকাঃ শিক্ষার শেষ নাই- ধ্রুব সত্য। অপর দিকে সত্য হলো সীমাহীণ শিক্ষা সবার জন্য যেমন প্রয়োজন নাই তেমনি সকল বিষয়ে সবাই শেখার যোগ্য বা সক্ষমও নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে উক্তরূপ বাস্তবতা কোন অবস্থাই আমরা অস্বীকার করতে পারি না। বাস্তবতার উক্তরূপ অনিবার্য কারণেই শিক্ষার শেষ না থাকলেও ’’শেখার’’ ক্ষেত্রে- ক) প্রয়োজণীয় (সীমা বা) বিষয় ও খ) (যোগ্যতা বা) সক্ষমতা অবশ্যই বিবেচনায় নেবার তাগিদ দেখা দেয়।

অর্থাৎ (শিক্ষার ইপ্সিত ফল পেতে হলে বাস্তবতার অনিবার্য কারণে) শিখার ক) প্রয়োজনীয় বিষয়, খ) শিক্ষার্থীর সক্ষমতা অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাদানব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। (অন্যথায় কাঙ্ক্ষিত ফল প্রাপ্তি সম্ভব হবে না।) অবশ্য প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক শেখার (শিক্ষার) প্রয়োজনীয় বিষয় ও সক্ষমতা নির্ধারণের উপায় কি? উক্ত প্রশ্নটি মূল আলোচ্য অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

আমরা জানি যে কোন কাজের ইপ্সিত ফল প্রাপ্তি কাজটির সম্পাদনে তার উপাদানসমূহের যথাযত সমন্বয় সাধন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। অনুরূপ শিক্ষার ইপ্সিত ফল প্রাপ্তিও শিক্ষাদান কর্মের উপাদানসমূহের সম্বনয় করার যথাযত প্রক্রিয়া গ্রহণ নিশ্চিত করার উপর নির্ভরশীল। উক্ত লক্ষে শিক্ষাব্যবস্থা শব্দটিতে অন্তরনিহিত উপাদানসমূহের উন্মোচন ও চিহ্নিত করা একান্তই প্রয়োজন। শিক্ষাদান কর্মের উপাদানসমূহ চিহ্নিতকরণ ও তার সমন্বয় প্রক্রিয়ার গুরুত্ব মূল অধ্যায়ে যুক্তিসহ বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ভূমিকাতে শুধু শিশু শিক্ষার প্রক্রিয়ার উপর বিশ্বের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাঁর সেই মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরবো।

’’দুইটি শিশু যদি একই রকম চরিত্র অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও প্রতিবর্তী এবং অন্যান্য শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে, ভিন্ন রকম পরিবেশে লালিত-পালিত করিয়া তাহাদিগকে সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকম অভ্যাসে অভ্যস্ত বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত করা যায়। বাল্যকালীন শিক্ষার কর্তব্য হইল শিশুর প্রবৃত্তিগুলিকে এমনভাবে শিক্ষা দিয়ে বিকশিত করা যাহার ফলে শিশুর চরিত্রের প্রয়োজনীয় গুণগুলি সুসমঞ্জস্যভাবে বর্ধিত হইতে পারে। এইরূপ শিক্ষার ফলে শিশুর মনভাব ধ্বং*সশীল না হইয়া হইবে সৃজনশীল; কো’পনস্বভাব না হইয়া সে হইবে স্নেহশীল, সে হইবে সাহসী, সরল এবং বুদ্ধিমান। …..যথায় শিশুর উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা আছে তথায়ই প্রকৃতই এইরূপ ফল পাওয়া যাইতেছে। যদি শিশুশিক্ষা সম্পর্কিত আধুনিক জ্ঞান এবং পরীক্ষিত প্রণালী প্রয়োগ করা যায় তবে এক পুরুষকালের মধ্যে আমরা এমন সমাজ গড়িয়া তুলিতে পারি যাহা হইবে প্রায় সম্পূর্ণ রো*গমুক্ত, বিদ্বে*ষমুক্ত, এবং মূ*র্খতামুক্ত।’’ (বার্ট্রান্ড রাসেল রচনা সমগ্র পৃ: ২৭৮, অনুবাদ : আত-ই-রাব্বি)

যে কোন উন্নত দেশ বা জার্মানিতে লক্ষ করলে দেখা যায়- যখন থেকে শিশুরা কিন্ডারগার্টেন যাওয়া শুরু করে তখন থেকেই ধীরে ধীরে শিশুদের আচরণে ক্রমান্বয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তণ বিশেষ করে মানবিক, নৈতিক, যৌক্তিক ও সততার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটছে। যে রূপ আচরণশীল ব্যক্তিকে আমরা সমাজ-রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক বলে থাকি। উন্নত দেশের শিক্ষা শুরুর ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায়- শিশুর উক্ত রূপ আচরণ বিকাশে পরিবারের কোনই ভূমিকা থাকে না। উন্নত দেশসমূহে কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের কোন পাঠ্যপুস্তক থাকে না এবং কোন অক্ষর জ্ঞানও দেয়া হয় না। এতে প্রতিয়মান হয়-

শুধু পাঠ্য পুস্তক ভিত্তিক শ্রেণী কক্ষে পাঠদান বা পারিবারিক শিক্ষা ব্যক্তিকে আদর্শ ব্যক্তি বা সুনাগরিক রূপে গড়ে তোলে এমন ধারণা মোটেই সঠিক নয়। কারণ ব্যক্তি মানুষের বাস্তব-জীবন ও তার সমাজ-জীবন সম্পৃক্ত অনেক বিষয় রয়েছে যাহার শিক্ষাদান প্রক্রিয়া থাকে ভিন্ন এবং সে বিষয়সমূহও যেমন পাঠ্যবয়ের অন্তর্ভুক্ত নয় তেমনি প্রতিটি পরিবারও সেসকল বিষয়সমূহ পরিপূর্ণ অবগত ও শিক্ষা দিতেও সক্ষম নয়। কিন্তু ঐ সকল বিষয়সমূহের শিক্ষা না পেলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন বিপন্ন হয়ে থাকে।

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিষয়সমূহকে ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয় বলা হয়। অপর দিকে ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার কিছু বিষয় রয়েছে যাহা মূলত: ব্যক্তির মনজগতের গঠণদানমূলক বিষয়। যে বিষয়সমূহ (ব্যক্তির মনজগতের মানসিক গঠণদান) শিক্ষার্থীর বয়স ভিত্তিক বিশেষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক দ্বারা বিশেষ প্রক্রিয়ায় শিক্ষাদান করতে হয়।

উন্নত দেশসমূহে শিক্ষার শুরু কিন্ডারগার্টেন হতেই শিশুদের মনজগতে বিশেষ মানসিক গঠণদান বিশেষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক দ্বারা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পর্যাযক্রমে শিক্ষাদান করা হয়। ব্যক্তির জীবনে মৌলিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের অবশ্য বিবেচনায় নিতে (জানতে) হবে মানুষ মূলত: কি?

মানুষ মূলত: জন্মগত বিশেষ এক শ্রেণীর প্রাণী মাত্র।
শুধু দৈ’হিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে মানুষ বলা হয় না। সমাজ গড়েতুলার মানবিক গুনসম্পন্ন আচরণ সক্ষমতার্জণের কারণে তাকে মানুষ বলা হয়। অর্থাৎ এক শ্রেণীর-প্রাণীর মানুষরূপে আ*ত্ম প্রকাশের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো তার-সমাজ গড়ে তুলার মূল উপাদান মানবিক ও নৈতিক যে গুণসমূহ সেই গুণসম্পন্ন আচরণসক্ষমতা।

অতএব মৌলিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে- ১। মানুষের সমাজ জীবন গড়ে তোলার মানবিক ও নৈতিকগুণসমূহ কি ও সেই গুণসম্পন্ন আচরণসক্ষমতার গুরুত্ব কি? এবং সেই সঙ্গে জানতে হবে- ২। মানবিক ও নৈতিকগুনসমূহ তথা মানুষের সমাজ জীবন গড়েতুলার মানবিক ও নৈতিক গুণসম্পন্ন আচরণসক্ষমতার্জণের উপায় কি?

(১। মানুষের সমাজ জীবন গড়ে তুলার মানবিক ও নৈতিকগুণসমূহ কি ও সেই গুণসম্পন্ন আচরণসক্ষমতার গুরুত্ব কি?) ব্যক্তির সমাজ জীবন গড়ে উঠা ও তার বাস্তব জীবনের নিশ্চয়তার বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করলেই তার মানুষরূপে আ*ত্ম প্রকাশের মৌলিক উপাদান তথা তার মৌলিক শিক্ষার বিষয় ও তার গুরুত্ব সহজেই বুঝা যায়। যাহা আমরা মূল অধ্যায়ে আলোচনা করবো।

ভূমিকা পর্যায়ে শুধু উপমার জন্য মনে করি-
চারটি চাকা নির্ভর একটি গাড়ী। চাকা চারটি ক, খ, গ, ঘ। গাড়ীটির যদি কোনই বা কোন একটি চাকা না থাকে তবে গাড়ীটি চলতে পারবে কি? পারবে না।
অনুরূপ- একজন আদর্শ সামাজিক মানুষরূপে আ*ত্ম প্রকাশের মৌলিক-উপাদান বা গুণসম্পন্ন আচরণ মনে করি ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি হলে উক্ত বিষয়সমূহের কোনই বা কোন একটির শিক্ষা অপূর্ণ থাকলে আদর্শ সামাজিক মানুষরূপে আ*ত্ম প্রকাশে পূর্ণতা পাবে কি? পাবে না।

অতএব আদর্শ সামাজিক মানুষরূপে আ*ত্মপ্রকাশের জন্য মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহ শিখার গুরুত্ব বহণ করে। প্রশ্ন থাকে- ২। মানুষের সমাজ জীবন গড়ে তোলার মানবিক গুণসম্পন্ন আচরণসক্ষমতার্জণের উপায় কি?

পরিবার ব্যক্তি মানুষের উৎস হলেও আমরা একটু মনযোগী হলেই দেখতে পাব বিভিন্ন কারণে পরিবার ব্যক্তির সমাজ জীবন গড়ে তুলার গুণসম্পন্ন আচরণসক্ষম করে গড়ে তুলতে পারে না। অর্থাৎ পরিবার ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহ পরিপূর্ণরূপে শিক্ষা দিতে পারে না। (কোটিতে কচিৎ জাতীয় মানদন্ড হতে পারে না।) পরিবারের অ*ক্ষ*মতার কারণ ও করণীয় মূল আলোচ্য অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে।

বিশেষভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-
মৌলিক শিক্ষাই এক শ্রেণীর প্রাণী মানুষকে সামাজিক মানুষরূপে গড়ে তুলার গুরুত্ব বহণ করে। অবশ্য ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়ে শিক্ষাদানে প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও যথাযত প্রক্রিয়া জানতে হয়। উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা লক্ষ করলে দেখা যায় ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহের শিক্ষাদান অতি সুপরিকল্পিতভাবে ও অতি যত্নের সাথে নিশ্চিত করা হয়। তাদের সুপরিকল্পিত শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার কারণেই শিক্ষার্থীরা তাদের সমাজ-রাষ্ট্রের আদর্শ আচরণশীল ব্যক্তি-নাগরিক রূপে গড়ে উঠে।

সঠিক প্রক্রিয়ায় মৌলিক শিক্ষাদান ব্যতিত জাতির আদর্শ ব্যক্তি-নাগরিক গড়ে তোলা মোটেই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা প্রসংশনীয় কিন্তু তবু কেন শিক্ষার অভিষ্ট্য লক্ষার্জণ সম্ভব হচ্ছে না !

ব্যর্থতার কারণ মূলত: মৌলিক শিক্ষারবিষয় নির্বাচণে গুরুত্ব না দেয়া এবং শিক্ষাদানে প্রক্রিয়াহীনতা।
প্রক্রিয়ার গুরুত্বের উপমা স্বরূপ উল্লেখ করতে হয়
যেমন- অঙ্কের সঠিক ফল পেতে হলে অঙ্ক সমাধানের সূত্র বা প্রক্রিয়া যেমন শিখতে ও জানতে হয় তেমনই সূত্র যথাযথ অনুসরণও করতে হয়। (নতুবা অঙ্কের সঠিক ফল প্রাপ্তি সম্ভব হয় না।) তদ্রূপ শিক্ষাদানেরও কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। শিক্ষার মান প্রত্যাশিত বা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পেতে হলে শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াসমূহ অবশ্যই শিখতে, জানতে ও যথাযথ অনুসরণ করতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রক্রিয়াগত অ’পূর্ণতা কি জানার এবং যথাযথ প্রক্রিয়া গ্রহণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও উপাদান বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত অতি সংক্ষেপে লেখাটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। (চলবে…)