চিত্রা নদীর ৬৩ দখলদারের তালিকা প্রকাশঃ উচ্ছেদে পদক্ষেপ নেওয়া হবে

696
342
চিত্রা নদীর ৬৩ দখলদারের তালিকা প্রকাশঃ উচ্ছেদে পদক্ষেপ নেওয়া হবে

স্টাফ রিপোর্টার

বিশ্ববরণ্যে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ও ক্রিকেট তারকা মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার স্মৃতিমাখা চিত্রা নদী। ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ চলচ্চিত্রটিও নদীটিকে স্বনামখ্যাত করেছে। নড়াইল শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি। শহরের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে নদীপাড়ে। এর ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় নদীতে। কয়েকদশক ধরে দখল ও দূষণের কারণে নদীটি এখন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।

জেলা ও সদর উপজেলা প্রশাসন নড়াইল শহরের ৬৩ জন দখলদারের তালিকা করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, শহরে দখলদারের সংখ্যা আরো বেশি। তালিকাভুক্ত দখলদার উচ্ছেদেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে বিলম্ব করছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চিত্রা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে ঝিনাইদহ ও মাগুরা হয়ে নড়াইলে প্রবেশ করেছে। জেলার মধ্যে ৪৬ কিলোমিটার অতিক্রম করে নদীটি খুলনা জেলার সীমান্তে গাজীরহাটে আতাই নদীতে পড়েছে। সেটি গিয়ে খুলনার রূপসা নদীতে মিশেছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব নদীর সীমানা চিহ্নত করা ও দখলদার উচ্ছেদ করা। নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না তা দেখা আমাদের দায়িত্ব। যেহেতু মূল শহরের ওপর দিয়ে নদীটি গেছে, তাই দখলদার উচ্ছেদ হলে পরিবেশ রক্ষায় ও দর্শনার্থীদের জন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো যেত।

স্থানীয় সচেতন মহল জানান, নড়াইল শহরটি গড়ে উঠেছে চিত্রা নদীর পাড়ে। শহরের বড় বাজার ‘রূপগঞ্জ বাজার’ নদীটির তীরে অবস্থিত। এ ছাড়া মূল শহরের পূর্বপাশের বসতবাড়ি এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও আদালত এলাকা নদীর তীরে। তাই নদীটি নড়াইল শহরের প্রাণ। এই শহরের বাসিন্দাদের গোসল, রান্নাসহ গৃহস্থলির নানা কাজে নদীর পানি ব্যবহার হচ্ছে। কৃষিজমিতে সেচ দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া নদী তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে শহরের অংশ সাজালে শহরবাসীর জন্য মনোরম ক্ষেত্র তৈরি হতো।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা ও সদর উপজেলা প্রশাসন যে ৬৩ জন দখলদারের তালিকা করেছে, সেটি শহরের শেখ রাসেল সেতু থেকে রূপগঞ্জ বাজারের খাদ্যগুদামের ঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা। এই তালিকায় রূপগঞ্জ বাজারের পূর্ব পাশের গলিপথের অধিকাংশ দোকান-পাটের বর্ধিতাংশ অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। এ বাজারের উত্তর পাশ থেকে চরেরঘাট, কুন্ডুবাড়িরঘাট ও পুরতান বাজার হয়ে সেতু পর্যন্ত নদী তীরে গড়ে উঠেছে পাকা-আধাপাকা বসতবাড়ি। এসব আবাসিক এলাকার দখলদাররাও তালিকাভুক্ত। তবে তালিকা ধরে অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, অনেক প্রভাবশালীর নাম সেখানে ওঠেনি। যা নদীর মধ্যে দখল দৃশ্যমাণ। এদিকে এই বাজার এলাকা ও আবাসিক এলাকায় নদীকূলে ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির অনেকেই পয়োনিষ্কাশন নালা নদীতে সংযোগ করেছেন। পানিতে ভাসছে পলিথিন ও বোতল। ফলে নদীর পানি দুষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) কার্যালয়ের তালিকায় দখলদারেরা হলেন মহিষখোলার আলম শেখ, তোতা মোল্লা, আইয়ুব মুন্সী, কুদ্দুস আকুঞ্জী, আবু জাফর, মরিয়ম বেগম, রওশনারা খাতুন, জয়নব বেগম, নাসির মৃধা, রেনু বেগম, দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ারা বেগম, মোহাম্মদ শরীফ, তহমিনা খানম, জাহানারা বেগম, তিতু মিয়া, জাকির হোসেন, আ. সাত্তার, তোতা মোল্লা, জাকির হোসেন, কালী রানী দাস, আকলিমা রহমান, সুশান্ত দেবনাথ, মাও. শফিউল্লাহ, অশোক কুমার কুন্ডু, সুকুমার কুন্ডু, সৈয়দ মুশফিকুর রহমান, লালিয়া বেগম, মিন্টু, সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান, নান্নু মোল্লা, মঈনউল্লাহ দুলু, জিয়াউর রহমান, বাহাউদ্দিন মোল্লা ও মোকাদ্দেস গাজী, ভওয়াখালীর মুজিবর রহমান, বিল্লাল হোসেন, শাহিন শরীফ, ইমরান শেখ, সাজ্জাদ হোসেন, মনিরুল ইসলাম, জহুরুল হক, সৈয়দা ফারহানা দিলরুবা ও আজাহার মোল্লা, হাটবাড়িয়ার প্রফুল্ল কুন্ডু, লস্কারপুরের বুলু সিকদার ও শাহাজাহান, কুড়িগ্রামের মনোজ কুমার কুন্ডু, প্রভাষ কুন্ডু, সন্তোষ কুমার, রবিউল ইসলাম, গোপীনাথ সাহা, আকাশ মোল্লা, নজরুল ইসলাম, রশিদ ব্যাপারী, অশোক কুমার কুন্ডু, মনি বাবু, বাসুদেব বিশ্বাস, নিরঞ্জন পাল ও কৃষ্ণপদ সাহা, পংকবিলার পরিতোষ কুন্ড, চরবিলার মাও. আবু জাফর এবং কমলাপুরের জীবন রতন কুন্ডু।

কথা হয় দখলদার তালিকাভুক্ত রূপগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী মনোজ কুমার কুন্ডু, প্রভাষ কুন্ডু ও সন্তোষ কুমার দে’র সঙ্গে। তাঁরা বলেন, পেরিফেরি করে যশোর কালেক্টর থেকে আশির দশকে এ জমির মালিকানা আমাদের হয়। সেই থেকে অন্তত ১০ বছর খাজনা দিয়ে আসছি। চলতি আরএস রেকোর্ডও আমরা পেয়েছি। এখন স্থানীয় প্রশাসন আমাদের কাগজপত্র দেখছে। ভওয়াখালীর বাসিন্দা জহুরুল হক কামাল বলেন, এ তালিকা সঠিক হয়নি। আমার বসতবাড়ির সব জমি আমার নামে রেকর্ড হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আইজবীবী এস এ মতিন এবং মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন স্বাবলম্বীর কর্ণধর কাজী হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, গত দুই বছর ধরে জেলা প্রশাসনকে বলা হচ্ছে নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে, কিন্তু সেটি করেনি। দখলদার উচ্ছেদের ব্যাপারে ও দূষণমুক্ত করতে প্রশাসনের দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়।

সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) মো. আজিম উদ্দিন বলেন, ‘ছয় মাস আগে দখলদারদের ওই তালিকা করা হয়েছে। সবার শুনানিও নেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদের জন্য এক মাসের মধ্যে নথি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবো।’ অনেক দখলদারের নাম তালিকায় নেই এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রূপগঞ্জ বাজারে ১০-১৫টি দোকান আছে, তাঁরা বন্দবস্ত নিয়ে আছেন।’ এ ছাড়া ‘জরিপ করে দেখা গেছে কয়েকজায়গায় নদীর মধ্যে ১৫-২০ ফুট জায়গা ব্যক্তি মালিকানাধীন। নদী ভেঙ্গে এ অবস্থা হয়েছে। দেখে মনে হবে নদী দখল, বাস্তবে এগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন।’

এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা’র দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন, ‘দখলের বিষয়টি যাচাই-বাছাই চলছে। এরপর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দূষণরোধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা আছে।’