নড়াইলে বন্ধ হয়ে গেছে হস্ত চালিত তাঁত শিল্প, প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার

7
40

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্ধ হয়ে গেছে নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী হস্ত চালিত তাঁত শিল্প। তাঁত পল্লীগুলোতে এখন আর গামছা, লুঙ্গী ও শাড়ী তৈরি হয়না। তাঁতের খট খট শব্দে তাঁতপল্লীগুলো আর মুখরিত হয়না। ঐতিহ্যবাহী এ কুটির শিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা না পাওয়া, এসব পণ্য তৈরির প্রয়োজনীয় সুতো ও রং-এর দাম বৃদ্ধি, যন্ত্রচালিত শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের দাপটে বন্ধ হয়ে গেছে সব তাঁত।

জানা গেছে, সদরের আফরা, কলোড়া, মির্জাপুর, আরাজি বাঁশগ্রাম, আগদিয়া, মাইজপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিলো প্রায় এক হাজার তাঁতী পরিবার। মাত্র ১০/১২ বছর আগেও চালু ছিলো জেলার বেশ কিছু তাঁতপল্লী। কিন্তু আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে সব তাঁত শিল্প। জীবন বাঁচাতে পৈত্রিক এ পেশা বদল করে এখন কেউ কৃষি শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি বা ভানচালক। তাঁতের পণ্য তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সমানতালে সহযোগিতা করছে। এখন তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন।

সদরের শেখাটি ইউনিয়নের আফরা গ্রামের সোহেল গাজী সর্বশেষ তিন মাস পূর্বে চালু তাঁত থেকে একটি গামছা তৈরির মাঝপথে তাঁত নষ্ট হয়ে যায়। পরে আর তিনি মেরামত করেন নি। এই অবস্থাতে পড়ে আছে। হয়ত এরপর বন্ধ হয়ে যেতে পারে নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প তাঁতের অধ্যায়। গ্রাম ঘুরে দেখা যায় এখন সুতো কাটার চরকা, বানাবার বিভিন্ন আনুসঙ্গ পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়।

তাঁতি সোহেল গাজী বলেন, আফরা গ্রামে প্রায় ৮০/৯০ পরিবারের ৩ শতাধিত তাঁত ছিল। পন্য উৎপাদনের সুতোসহ অন্যান্য উপকরনের দাম বেশী এবং আমাদের উৎপাদিত কাপড়ের দাম কম। তারা এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কয়েকবার চড়া সুদ গুনতে হয়েছে। সরকারি কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় ধীরে ধীরে এই পেশা থেকে সরে এসেছেন বলে জানান ।

একই গ্রামের গাজী ফরিদুলের নিজের নামেই চলতো এসব গামছা ও লুঙ্গি। জেলা ও জেলার বাইরে বিক্রি করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, পণ্য উৎপাদন করে লোকসানের মুখ দেখতে হয়। সরকারিভাবে যদি সহায়তা পাওয়া যায় তাহলে আবার তাঁত পণ্য ঘুরে দাড়াবে বলে মনে করেন।

সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক মনিরুজ্জামান বলেন, মির্জাপুর ও রুখালি গ্রামে তাঁতি সম্প্রদায়ের ৩ শতাধিক পরিবার এক সময় তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। সর্বশেষ দু’ঘর এ পেশার যুক্ত থাকলেও তারা তাঁত বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ হিসেবে জানান, একদিকে তাঁত পণ্য প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না। অন্যদিকে এ পেশায় জড়িতদের সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হয়। এদের সাথে অন্য মুসলিম সম্প্রদায় সমাজ সামাজিকতা, মেলামেশা ও বিয়ে-সাধি করতে চায়না। এসব কারণেও একটি অংশ এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া গ্রামে প্রায় ৮০ ঘর কারিগর পরিবারের বসবাস। প্রায় ২ শতাধিক তাঁতের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন হতো। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারনে সবাই পেশা বদল করেছেন। এ গ্রামের জসিম উদ্দিন বলেন, তাঁতের কাজ ভাল ছিলো, ঘরে বসে করা। ঘরের মেয়েরাও এ কাজে সহায়তা করতো। কিন্তু এখন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে কৃষি কাজ করতে হচ্ছে। সরকার সহযোগিতা করলে পুনরায় তাঁত চালু করা সম্ভব হবে বলে জানান।

নড়াইল শাড়ি কাপড় মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিকাশ কুরি বলেন, আগে তাঁতের বিভিন্ন পণ্য বিক্রয় করলেও বর্তমানে তা পাওয়া যায়না ফলে টেক্সটাইলের শাড়ি লুঙ্গি, গামছা বিক্রি করেন।

নড়াইল শিল্প সহায়ক কেন্দ্র বিসিকের উপ পরিচালক এস.এম কামরুল হাসান বলেন, তাঁতে তৈরি পণ্যের চেয়ে টেক্সটাইল মিলে উৎপাদকৃত গামছা, লুঙ্গি, শাড়ীর মূল্য কম। বৃহৎ শিল্পের মারপ্যাচে কুটির শিল্প হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। তবে প্রয়োজনীয় ফান্ড পেলে কারিগরদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে বলে জানান।