ডিজিটাল বৈষম্য : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

10
5
ডিজিটাল বাংলাদেশ
ডিজিটাল বাংলাদেশ

মো.বেলায়েত হোসেন

বৈষম্য আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি শব্দ। আমরা অনেক রকম বৈষম্যের কথা জানি। আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, নিন্মমধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্তের পরস্পরের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য আমাদের সামনে আছেই। গ্রাম ও শহরের বৈষম্য আমাদের সমাজব্যবস্হাকে প্রকটভাবেই তুলে ধরছে। এসব বৈষম্যের পাশাপাশি ডিজিটাল বৈষম্য আমাদের সামনে আরোবেশি দৃশ্যমান হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনি ইশতাহারে উল্লেখ করেছিলেন ‘ আমার গ্রাম আমার শহর’।

এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি সকলকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন শহরের সবসুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে এবং এর মাধ্যমে ২০৩০ সালে এসডিজি এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সে পথেই এগিয়ে চলছে।

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার করোনাকালেও ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপির লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। পার ক্যাপিটাল ইনকাম বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২ হাজার ৫শত মার্কিন ডলার ছাড়িছে গেছে। করোনা মহামারির সময় সারাবিশ্ব যখন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে নানারকম সমস্যা মোকাবিলা করে চলছে বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম না হয়েও আর্থিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্ব ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে পারার কারণে।

করোনাকালে অনেক সমস্যাকে পিছনে ফেলে ডিজিটাল বৈষম্য আমাদের সামনে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে, জীবনযাত্রাকে করছে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়,তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে বহু মানুষ এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এটাও মেনে নিতে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আমাদের দেশের অনেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পরেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ভিশন ২০২১ এর মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিলেন এবং এর মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনে পথ দেখালেন, তখন দেশবাসী এটাকে লুফে নিলেন। আমরা এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা ভোগ করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় সবাই সমানভাবে এ সুবিধা গ্রহণ করতে পারছি না।

Digital Discrimination বা ডিজিটাল বৈষম্য প্রথম বিশ্ববাসীর সামনে আনেন ড্যান লায়ন ২০০৩ সালে তার বই ”Surveillance as Social Sorting: Privacy, Risk and Digital Discrimination’ এ। Digital Discrimination কে আগে ডিজিটাল ডিভাইড বলা হতো। গত শতাব্দীর শেষ নাগাদ ডিজিটাল বৈষম্যের বিষয় নিয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন নাইজেরিয়ার জন দাদা নামের এক ব্যক্তি। ২০০০ সালের মে মাসে জন দাদার প্রস্তাবের আলোকে জাপানের ওকিনাওয়ায় জি-৮ সন্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ডিজিটাল বৈষম্য বিষয় নিয়ে কথা বলেন। জন দাদা ২০০২ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জাতিসংঘের এক সভায় ডিজিটাল বৈষম্যের তখন ডিজিটাল ডিভাইড ‘ পদটি ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। এ সভায় তিনি ভবিষ্যতের ডিজিটাল সমাজের একটি রূপরেখাও তুলে ধরেন।

করোনা অতিমারিকালে বিশ্বের সকল দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। ব্যক্তিগত ও আর্থিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে সকল দেশই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দৈনিক কার্যক্রমকে অনলাইনভিত্তিক করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশেও সরকারি-বেসরকারি নানারকম কার্যক্রমকে অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। অফিস আদালত, ব্যাংক, শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্রয় বিক্রয়সহ অনেক রকম সেবার ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটা এবং ব্যাংকিংসেবা এখন খুব জনপ্রিয়। মানুষ ঘরে বসেই সবকিছু তার পছন্দমতো কেনাকাটা করতে পারছে। খাবার অর্ডার দেওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অফিসের চাকরিজীবীদের বেতন তোলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন জমা দেওয়া, সকল ইউটিলিটি বিল

পরিশোধ, পাসপোর্টের জন্য টাকা জমা দেওয়া সবই অনলাইনে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়েছে। সশরীরে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল পরিশোধ করা কিংবা ব্যাংক থেকে টাকা তোলা বা জমা দেওয়া মানুষ এখন আর পছন্দ করে না। এমনকি আদালতের বিচার কার্যক্রমও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ভার্চুয়ালি শুরু হয়েছে।

অনলাইনভিত্তিক এসব সেবা শহুরে মানুষের জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুললেও শহর ও গ্রামের মানুষের একটা বড়ো অংশ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও আর্থিক কারণে তারা এ সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারছে না। এছাড়া অবকাঠামোগত সমস্যার কারণেও অনেক মানুষকে এ সুবিধার আওতায় আনা যাচ্ছে না। বিআরটিসির তথ্যমতে দেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা কমবেশি ১৮ কোটি। শহর ও গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষের অধিকাংশের স্মার্টফোন নেই। দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটিরও বেশি।

বিশ্বে সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। দেশে মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি, আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটিরও বেশি। এরমধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ কোটি ২৩ লাখেরও বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকার কারণে ডিজিটাল বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি ডিজিটাল বৈষম্যের স্বীকার। প্রযুক্তিক্ষেত্রে অসমতা দেশের জনগণের মধ্যকার বর্তমান বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ।

করোনাকালে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার সুযোগসহ অনলাইনসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ,কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেবাগুলোর সহজিকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতাও প্রয়োজন। আর এ দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও নিন্মবিত্তের মানুষের ঘাটতি রয়েছে। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ঘাটতি আরও বেশি। বর্তমানে দেশের শতকরা ৫৫ ভাগ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট সংযোগ নেই, ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন নেই । এসব ঘাটতি পূরণ করার জন্য ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। আইসিটি বিভাগ থেকে দেশের সকল ইউনিয়নে পর্যায়ক্রমে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেওয়া কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিদ্যমান ইন্টারনেটের গতির তারতম্য দূর করাসহ ইন্টারনেটকে সুলভ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।