লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ মুক্তিযুদ্ধকালে নকশালরা থানা দখলের কাছাকাছি এসে ব্যর্থ হয়

1
8
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ- পুনরায় যশোর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

মুক্তিযুদ্ধের সময় লোহাগড়া থানার নিয়ন্ত্রণ পাক সমর্থক পুলিশ ও রাজাকারদের হাতে থাকলেও থানা সদরের বাইরে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এপ্রিল মাসের পর থেকে সমগ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ই পি সি পি (এম এল) অর্থ্যাৎ নকশালদের হাতে। নকশালদের ভয়ে রাজাকাররা নদীর এপারে স্বাভাবিকভাবে আসতে পারতো না। এপারে আসতে হলে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই আসতে হতো। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত নকশালদের হাতে এ নিয়ন্ত্রণ থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসার পর অবশ্য নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যায়। জুলাই মাসের শেষ দিকে ২/১ জন মুক্তিযোদ্ধা আসা শুরু করলেও আগষ্ট মাসের মাঝামাঝির দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসতে শুরু করে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতির সুযোগে নকশালরা বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। নকশালরা তাদের গেরিলা যুদ্ধের বিস্তৃতি ও নিয়মিত বাহিনী গঠনের কাজ সুসংগঠিতভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ৩ সদস্যের সামরিক কমিশন গঠন করে। সামরিক কমিশনের আহবায়ক হন জেলা কমিটির সদস্য নুর মহম্মদ এবং জেলা কমিটির সম্পাদক শামসুর রহমান ও বিমল বিশ্বাস সদস্য হন। ২০ আগষ্ট আরেক সভায় বিমল বিশ্বাসকে নকশালদের সেনাবাহিনী প্রধান এবং নুর মহম্মদকে রাজনৈতিক কমিশনার নিযুক্ত করা হয় (তথ্য সূত্রঃ ‘৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায়’- শামসুর রহমান)।

জুন মাসের প্রথম দিকে নকশালরা প্রথমে তাদের প্রধান ঘাঁটি পুলুমের নিকটবর্তী শালিখা থানা দখল করে নেয়। এরপর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মহম্মদপুর থানা দখল করে নেয়। মহম্মদপুর থানা দখলে অন্যান্যদের সাথে নেতৃত্ব দেয় লোহাগড়ার দুই নেতাÑগন্ডবের মমতাজ ও মহিশাহপাড়ার আব্দুর রউপ। শালিখা ও মহম্মদপুর থানা ছাড়াও আরো প্রায় ৫/৬ টি থানার অধিকাংশ এলাকা নকশালদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এরপর তারা লোহাগড়া থানা দখলের পরিকল্পনা করে।

লোহাগড়া থানায় তখন ২০ জনের মত পুলিশ ও ৫০ জনের মত রাজাকার ছিল। পুলিশ-রাজাকাররা থানার চার পাশে বিশাল ড্রেনের মত কেটে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করেছিল। এছাড়া বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার নির্মাণ করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করেছিল। নবগঙ্গা নদীর এপারে নকশালদের মুক্ত এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই নকশালদের সাথে রাজাকারদের গুলি বিনিময় চলতো। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল হিসাবে নকশালরা এভাবে গুলি ফুটিয়ে থানার রাজাকারদের ব্যস্ত রাখতো। নকশালরা একটা গুলি ফোটালে রাজাকাররা অন্ততঃ ১০টি গুলি ফোটাতো। নকশালদের এভাবে গুলি ফোটানোতে অনেক সময় স্থানীয় লোকজন বিরক্ত হতো। কারণ নকশালদের এধরনের গুলি ফোটানোতে স্থানীয় লোকজন রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতিত হত। কারা গুলি ফুটিয়েছে তা জানার জন্য রাজাকাররা স্থানীয়দের নির্যাতন করতো। নকশালদের এভাবে থানা লক্ষ্য করে গুলি ফোটানোর দৃশ্য আমরা সামনে থেকে দেখেছি। আমাদের বাড়ির সামনে তখন বড় বড় আমগাছ ছিল। নকশালরা ওই গাছের তলায় বসে শর্ট জামা-কাপড় পরে নিত। যাতে সহজে দৌড়ে পালানো যায়। ্এরপর কুন্দশী নদীর পাড়ে গিয়ে কয়েকটি গুলি ফুটিয়ে পালিয়ে যেত। রাজাকাররা ওই গুলির জবাব দিতে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করতো। গুলির শব্দ শুনে আমরা দ্রুত ঘরের ‘ডোয়ার’(ঘরের পোতা) আড়ালে অথবা বাঙ্কারের মধ্যে আশ্রয় নিতাম। কুন্দশী গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে তখন এভাবে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

লক্ষিপাশা বাজারটি তৎকালে কালিবাড়ির সামনে ছিল। বাজারের আশপাশেও একাধিক সুরক্ষিত বাঙ্কারে রাজাকারদের সার্বক্ষনিক পাহারা থাকতো। উল্লেখ্য উপজেলা সিস্টেম চালু হবার পর এই বাজারটিই স্থানান্তরিত হয়ে লক্ষিপাশা চৌরাস্তায় চলে আসে। সে বছর সর্বকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে এমনকি ঘরের মধ্যেও পানি উঠে গিয়েছিল। আমাদের ঘরের মধ্যে না উঠলেও প্রায় পোতা সমান পানি হয়ে গিয়েছিল। গোয়াল ঘরের পোতা অপেক্ষাকৃত নীচু হওয়ায় ঘরের মধ্যে পানি উঠে গিয়েছিল। আমাদের গরুগুলি বাধ্য হয়ে মনিবাবুর বাড়ির উচু স্থানে নিয়ে রেখেছিলাম। লোহাগড়া বাজারের অধিকাংশ এলাকা তখন বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। লোহাগড়া বাজার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লোহাগড়ায় কোন বাজার না থাকায় এপারের কেউ কেউ লক্ষিপাশা বাজারে যেত।

লক্ষিপাশা বাজারে তখন লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফে আটা দিত। যারা রাজাকারের ভয়ে লক্ষিপাশা বাজারে যেতে ভয় পেত তারা কালনা সিএন্ডবি বাজারে যেত। কালনায় সিএন্ডবি পাকা রাস্তার মাথায় অর্থ্যাৎ বর্তমানে যেখানে একটি মাদ্রাসা হয়েছে (ভোলা পাচু‘র বাড়ির সামনে)ওই স্থানে নিয়মিত বাজার বসতো। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ছাড়াও সেখানে গরু ছাগলও বিক্রি হতে দেখেছি। কুন্দশী চৌরাস্তার কিছু দুর এগিয়ে লোহাগড়াÑ কালনা পাকা রাস্তার উপর পানি হয়ে গিয়েছিল। ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্থ যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে নকশালরা লোহাগড়া থানা দখলের উপযুক্ত সময় মনে করে। থানা আক্রমনের পূর্বে তারা সড়ক পথে পাকসেনা আসার পথ বন্ধ করে দেয়।

কুন্দশীর সি এন্ড বি ঘাটে তখন যানবাহন পারাপারের জন্য একখানা কাঠের ফেরি ছিল। ফেরিটি থানা পুলিশের প্রয়োজনেই ব্যবহার হতো। লোহাগড়া থানা আক্রমনের সময় নকশালরা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে ফেরি খানিকে ডুবিয়ে দেয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে নকশালরা থানা আক্রমন করে। গন্ডবের মমতাজ ,মহিশাহপাড়ার রউপ ও লক্ষিপাশার ওমর ফারুক থানা আক্রমনে নকশাল যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেয়। থানায় থাকা রাজাকার-পুলিশের সাথে নকশালদের তীব্র লড়াই হয়। দুইদিন থানা ঘিরে রাখার পর রাজাকাররা পরাজয় মেনে নিয়ে সারেন্ডার করতে সাদা পতাকা উড়িয়ে সময় ক্ষেপন করতে থাকে। তখন তাদের সাহায্য করতে নড়াইল থেকে অতিরিক্ত রাজাকার এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। রাজাকারদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা নকশালদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়।

রাজাকাররা গানবোট জাতীয় নৌযান নিয়ে আসায় নকশালরা মনে করেছিল মিলিটারী এসেছে। নকশালরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। থানা দখলের এই যুদ্ধে পাঁচুড়িয়ার মিজানুর নামে একজন নকশাল যোদ্ধা মারা যায় এবং ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। রাজাকাররা লোহাগড়া বাজার দখল করে নেয়।

প্রয়াত সাংবাদিক শামসুর রহমান সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে থেকে দখলদার পাকবাহিনী ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত শক্তি সশস্ত্র লড়াই-এ অবতীর্ন হয় ,পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম এল) তাদের অন্যতম। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পার্টি নেতৃত্বে গঠিত হয় সেনাবাহিনী। যারা দীর্ঘ নয় মাস বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে দখলদার পাক বাহিনীর পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাদের এ অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম এল) বা ইপিসিপি (এম এল) এর এই প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যশোর জেলা একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এখানে পার্টির সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন মুক্ত রাখতে সক্ষম হয় বিশাল এলাকা। কৃষকের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ মুক্ত অঞ্চলকে ঘোষণা দেয়া হয় কৃষক রাজের এলাকা হিসাবে। কিন্তু পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল রাজনৈতিক লাইনের কারনে এ যুদ্ধের ফলাফল এক করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে পার্টির বিপর্যয় ডেকে আনে’। লেখা চলবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক ।)