লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ বিভিন্ন গ্রামে ডিফেন্স পার্টি গঠন ও নকশালদের প্রভাব

106
30
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ- পুনরায় যশোর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

পাকবাহিনী নড়াইল শহর দখল করে নেবার পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামে-গঞ্জে দালাল ও লুটেরা শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এরা সুযোগ বুঝে গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়িতে লুটপাট শুরু করে। এসময় লোহাগড়াতেও চোর-ডাকাতদের তৎপরতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকরা বেশি ক্ষতির শিকার হয়। সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ প্রথমদিকে কিছু চুরি ও লুটপাটের বিচার শালিশের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নড়াইলের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হওয়া যশোরের তৎকালীন সহকারি কমিশনার (ম্যাজিষ্ট্রেট) ডঃ সা’দত হুসাইন (পরবর্তীকালে তিনি মন্ত্রী পরিষদ সচিব হয়েছিলেন) এই বিচার আদালত পরিচালনা করতেন। তবে নানান কারণে সে তৎপরতা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয় না।

এদিকে নড়াইল শহর পাকবাহিনী দখল করে নিয়েছে তাই যে কোন সময় লোহাগড়াতেও অভিযান চালাতে পারে এ আশঙ্কায় প্রশিক্ষণ গ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং ক্যাম্প ছেড়ে চলে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী কোন নির্দেশনা না দিয়েই ট্রেনিং ক্যাম্প ভেঙ্গে দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদ নেতারা একে একে যার যার মত ভারতে পাড়ি জমালেন। এদিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করা কালে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিতরণ করা অস্ত্রগুলি তাদের কাছেই রয়ে গেল। অস্ত্র হাতে পেয়ে অস্ত্রধারীদের কেউ কেউ বিপথে চলে যায়। বিপথগামীরা চোর-ডাকাতদের সাথে মিশে যায়।

এসময় থানা সদর এলাকা পাক সমর্থক পুলিশের নিয়ন্ত্রনে থাকলেও গ্রাম-গঞ্জে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। বিভিন্ন স্থানে চুরি-ডাকাতি ও লুঠতরাজ বেড়ে যায়। গ্রামের সামর্থ্যবান গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি হতে থাকে। কোন কোন বাড়িতে একাধিকবার ডাকাতির ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। বিশেষ করে হিন্দু বাড়িতে রাতে ডাকাতি ছাড়াও কোন কোন স্থানে দিনের বেলায়ও ডাকাতি লুটপাটের ঘটনা ঘটে। চোর ডাকাত ও লুটেরাদের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামবাসীরা বাধ্য হয়ে ডিফেন্স পার্টি বানিয়ে গ্রামে পাহারার ব্যবস্থা করে।

আমাদের কুন্দশী গ্রামে কয়েকটি বাড়িতে ডাকাতি হবার পর গ্রামবাসীরা একাধিক ডিফেন্স পার্টি গঠন করে গ্রামে পাহারার ব্যবস্থা করে। এরূপ পাহারা চলার এক রাত্রিতে ডিফেন্স পার্টির সদস্য ওলিয়ার রহমান , আকরামুজ্জামান বাবলু ও আতিয়ার রহমান টুলুসহ তাদের দলের পাহারার দায়িত্ব পড়ে।

পাহারা শুরু হবার আগে পাহারা দলের অন্য সদস্যরা আসার আগ পর্যন্ত ওরা কিছুক্ষণ নেপাল দত্তের বাড়িতে লুডু খেলতে বসে। খেলার এক পর্যায়ে ছক্কা পড়া নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়। খেলা পন্ড করে রাগে রাগে তিন বন্ধু রাস্তায় এসে দেখে একজন লোক একটা রাইফেল নিয়ে একাই হেঁটে যাচ্ছে। তিন বন্ধু রাইফেলধারী ব্যাক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তাকে ধরে ফেলে। এ সময় রাইফেলধারী ব্যাক্তি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেয়। কিন্তু ওরা তার কথা বিশ্বাস করে না। ওরা তার রাইফেলটা কেড়ে রাখে এবং পরদিন সকালে উপযুক্ত প্রমান দিয়ে রাইফেলটা নিয়ে যেতে বলে। লোকটা নীরবে চলে যায়। তবে সে আর কোন দিন রাইফেলটা নিতে আসে নাই।

এদিকে তিন বন্ধুর কেউই রাইফেল চালাতে পারতো না। তাই ওরা আমার চাচা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য রফিউদ্দিন খানের কাছে রাইফেলটা জমা দেয়। এদিকে রাইফেল পেয়ে গ্রামের ডিফেন্স পার্টির শক্তি বৃদ্ধি পায়। মুখে মুখে রাইফেল প্রাপ্তির খবর ছড়িয়ে পড়ায় আমাদের গ্রামে আর ডাকাত আসতো না। তবে আশপাশের গ্রামে চুরি-ডাকাতি অব্যাহত থাকে।

এদিকে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ অর্থ্যাৎ স্বাধীনতার স্বপক্ষের ছাত্র-যুবকরা দলে দলে মুক্তিবাহিনী হিসাবে ট্রেনিং গ্রহনের জন্য ভারতে চলে যায়। তখন পাক সরকার টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্থানের গভর্ণর নিয়োগ দেয়। টিক্কা খান দায়িত্ব নিয়েই পাকবাহিনীকে বাঙ্গালীদের প্রতি আরো কঠোর নির্দেশনা জারী করলেন এবং এতদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দিতে রেডিও ও মাইকে ঘোষণা করতে থাকে।

ওরা এমন ভাব দেখাতে থাকে যেন সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা পিসকমিটি এবং আলবদর-রাজাকার ইত্যাদি নানা নামে আবির্ভুত হতে থাকে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকেই ঢাকায় খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহবায়ক করে ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট পিস কমিটি গঠিত হয়। খাজা খয়ের উদ্দিন আহবায়ক নিযুক্ত হলেও মুলতঃ জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম ছিলেন পিস কমিটির কার্যকরী প্রধান। জামায়াতে ইসলাম ,মুসলিম লীগ,পিডিপি ও নেজামে ইসলাম পার্টির নেতারা সহ তাদের বিভিন্ন স্তরের সমর্থকরা পিস কমিটির সদস্য হয়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পিস কমিটির জেলা, মহাকুমা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

লোহাগড়ায়ও পিস কমিটি গঠিত হয়। লোহাগড়া স্কুলের মাঠের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পের সাথে যুক্ত থাকা কেউ কেউ পিস কমিটিতে নাম লেখালেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ থানায় রাত্রি যাপন করতেন। এরপর মে মাসে খুলনায় মাওলানা এ কে এম ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী। পাক সরকার একটি অর্ডিন্যান্স জারী করে রাজাকার বাহিনীকে আইনগত বৈধতা দেয়।

পাকসেনারা রাজাকারদের রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে এক একটা রাইফেল দিয়ে দেয়। অসৎ প্রকৃতির এসব লোকেরা রাইফেল হাতে পেয়ে সকল অপকর্মে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করতো। পিস কমিটি ও রাজাকাররা পাকবাহিনীকে গ্রামের পথঘাট চিনিয়ে দেয়া , গ্রামের যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে ওদের ক্যাম্পে পৌছে দেয়া , ওদের সাথে থেকে লুটপাট করা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকের বাড়ি চিনিয়ে দেয়ার কাজ করতো।

অস্ত্র হাতে থাকায় রাজাকাররা কখনও কখনও নিজেরাই দল বেঁধে এসব কাজে লিপ্ত হতো। লোহাগড়ার অনেকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি হয়। পিস কমিটি ও রাজাকাররা পাক সরকারের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পিস কমিটি ও রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সকল কাজে পাকবাহিনী ও পাক সমর্থক পুলিশদের সহায়তা করতে থাকে। গ্রামের অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিরা পিস কমিটির সাথে যুক্ত হয়। পিস কমিটির নেতারা পুলিশ পাহারায় চলাফেরা করতে থাকে। পিস কমিটি ও রাজাকারদের দাপট দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা জন্মাতে থাকে।

আমাদের গ্রামের ডাঃ মহিউদ্দিন পূর্ব থেকেই মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি তৎকালে লোহাগড়া বাজারের গন্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ওই আমলে রাজনৈতিক নেতা ,সরকারি কর্মকর্তা অথবা থানা পুলিশের যে কোন কর্মকর্তা লোহাগড়ায় আসলে একমাত্র তার চেম্বারেই সুন্দর বসার ব্যবস্থা ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে লোহাগড়া স্কুলের মাঠে ট্রেনিং ক্যাম্প গঠনে অন্যদের সাথে থাকলেও পরে পিস কমিটির সাথে যুক্ত হন। পিস কমিটি গঠনের পর তিনি পুলিশ পাহারায় চলাফেরা করতেন এবং পুলিশ পাহারায় গ্রামের বাড়ি আসতেন। এসময় একদিন তার ভাই-ভাইপোদের সাথে গ্রাম্য প্রতিপক্ষের ছোটখাট একটা বিষয় নিয়ে গোলমাল বাঁধে।

একপর্যায়ে তার ভাইপো ওলিয়ার রহমান প্রতিপক্ষদের ভয় দেখানোর জন্য দৌড়ে আসে ডিফেন্স পার্টির উদ্ধারকৃত সেই রাইফেলটা নিতে। খবরটা পিস কমিটিসহ থানা পুলিশের কাছে পৌছে যায়। রাইফেলটা দ্রুত উদ্ধার করে থানায় নেয়া যেন পাক পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে পড়ে। একদিন বিকালে ডাঃ মহিউদ্দিন কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে আমার চাচাকে বললেন রফিক ভাই তোমার কাছে থাকা রাইফেলটা দিয়ে দাও। আমার চাচা পরিস্থিতি বুঝে কথা না বাড়িয়ে রাইফেলটা দিয়ে দিলেন।
এসময় একদিন বাজারে গিয়ে শুনি লোহাগড়া হাইস্কুলের খেলার মাঠের পূর্বদিকে পাট ক্ষেতের মধ্যে একজন লোকের গলাকাটা লাশ পড়ে আছে। অন্যদের সাথে দ্রুত সেখানে দেখতে গেলাম। দেখি ধারালো কোন অস্ত্র দিয়ে ঘাড় সমান করে কেটে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা লাশটি পাট ক্ষেতের মধ্যে পড়ে আছে।তবে লাশের সাথে মাথা নেই। তৎকালে ওই স্থানে আজকের মত এত বসতি ছিল না। পুরো ওই এলাকাটি ছিল কৃষি জমি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অনতিদুরে আরেক পাট ক্ষেতে মাথাটি পাওয়ার পর জানা যায় গলাকাটা ওই লোকটি পারছাতড়া গ্রামের আবু মিয়া।

লোকমুখে শোনা যায় ‘চুরি ডাকাতির অপরাধে নকশাল বাহিনীরা’ তাকে হত্যা করেছে। নকশাল বাহিনী নামটি তার আগে তেমন শোনা যায়নি। তবে এমন বাহিনীর নাম শোনা না গেলেও চুরি ডাকাতির অপরাধে এই লোকটিকে খুন করায় সকলেই যেন খুশি হয়। পরদিন সকালে লোহাগড়া হাইস্কুলের দেয়ালে সুন্দর হস্তাক্ষরে নকশাল বাহিনীর বিভিন্ন দেয়াল লিখন দেখা যায়। দেয়াল লিখনের সাথে চীনা কম্যুনিষ্ট পার্টির অন্যতম নেতা কমরেড মাও সেতুং এর সুদৃশ্য মুন্ডু (মাথা) আঁকা দেখা যায়। নকশাল বাহিনীর সদস্যরা তখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে নকশাল বাহিনীর নামটি নিয়ে সর্বত্র আলোচিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহকালে বামপন্থী ইপিসিপি (এমএল) নামে যারা কিছু রাইফেল নিয়ে যায় তারাই পরবর্তীতে নকশাল বাহিনী নামে পরিচিত হয়।

নকশালরা গ্রামের দিকে এরকম আরো কিছু লোককে চুরি ডাকাতি ও লুটপাট করার অপরাধে একইভাবে খুন করে বলে জানা যায়। অপরাধী শ্রেণির লোকদের খুন করায় অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সাধারণ মানুষের কাছে ‘জনপ্রিয়তা’ পায়। নকশালদের হাতে চোর-ডাকাত ও লুটেরাদের খুন হওয়ার বিষয়ে যশোরের প্রয়াত সাংবাদিক শামসুর রহমান কেবল সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত সবিস্তার প্রতিদেনে লিখেছেন, ‘শান্তি কমিটির লোকজন শায়েস্তা করার জন্য পার্টি নেতৃত্বে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় ১৫ মে লোহাগড়ার এক লুটেরার বাড়িতে। তিনি এই এলাকায় শান্তি কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন।

এই অভিযানে শান্তি কমিটির ৪ জন নিহত হয় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। ১৭ মে নলদী বাজারে হামলা চালানো হয় শান্তি কমিটি একটি আখড়ায়। পূর্বাহ্নে খবর পেয়ে কয়েকজন পালাতে সক্ষম হয়। বাকী কয়েকজন আটক হয়। পরে ক্ষমা প্রার্থনা করায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এ সময় ইপিসিপি (এমএল) এর আঞ্চলিক কমিটি লিফলেট ও পোস্টারের মাধ্যমে এক সপ্তাহের মধ্যে লুটের মালামাল ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়। লুটপাটকারীরা যে সমস্ত সংখ্যালঘুর বাড়ি থেকে মালামাল এনেছিল পুনরায় সেসব তাদের বাড়িতে রেখে আসে। বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া হিন্দু সম্প্রদায় মালামাল ফেরত পেয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। পার্টির সুনাম দারুনভাবে বৃদ্ধি পায়। কিছু কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্ন লুটপাট চলতে থাকলেও নকশাল পার্টি স্বল্প সময়ে তা বন্ধ করতে সক্ষম হয়। এসময় লাহুড়িয়ার কুখ্যাত ছিরুসহ ২৫ জন লুটেরাকে পার্টি নেতৃত্বে জনগণ বিভিন্ন স্থানে তাদের খতম করে’। লেখা চলবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব)