নড়াইলে গণকবরে শায়িত ৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন ও স্মাকরলিপি পেশ

0
45
নড়াইলে গণকবরে শায়িত ৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন ও স্মাকরলিপি পেশ
নড়াইলে গণকবরে শায়িত ৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন ও স্মাকরলিপি পেশ

স্টাফ রিপোর্টার

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সদরের তুলারামপুর গ্রামটি ছিল নড়াইলের প্রবেশদ্বার এবং ভৌগলিক রণকৌশলগত এলাকা। মুক্তিযুদ্ধের উষাালগ্নে এ গ্রামের আওয়ামী সমর্থক তরফদার বংশ ও স্থানীয় আরও কয়েকটি পরিবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর নজরদারি এবং প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়তে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন।

বঙ্গবন্ধু’র যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে শত্রুপক্ষকে নড়াইল শহরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য তুলারামপুর ব্রীজ ভাঙ্গার চেষ্টা করা এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে শত শত মানুষের সাথে এই তরফতার পরিবারও দেশী অস্ত্র নিয়ে অংশ নেন। সদরের বেতাঙ্গা হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম জুন মাসের শেষের দিকে রাজাকাররা হানা দিলে তরফদার এবং তাদের সহযোগীরা এগিয়ে এসে সাধারন মানুষকে নিরাপত্তা দেয়।

কিন্তু হঠাৎ করে ১৭ জুলাই ভোরে পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনী তরফদার বাড়িতে ঢোকে। সঙ্গে ছিল কুখ্যাত রাজাকার নড়াইল মহাকুমা (বর্তমান জেলা) পিচ কমিটির চেয়ারম্যান সোলায়ম্যান মোল্যা। নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট হাই স্কুলের সহকারী প্রধানশিক্ষক আতিয়ার তরফদার, ইউনিয়ন আ’লীগ নেতা ছালাম তরফদার, ছাত্রলীগ নেতা মাহতাব তরফদার, তহশিলদার রফিকুল ইসলাম তরফদার, তুলারামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলতাফ হোসেন তরফদার, ড্রাইভার মকবুল হোসেন শিকদার, ইউনিয়ন আ’লীগ নেতা কাইজার মোল্যা ও আ’লীগ সমর্থক মোকাম মোল্যাসহসহ ২৮ জনকে চোখ বেঁধে নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে ধরে এনে শারীরিক নির্যাতন শুরু করে।

১৯ জুলাই রাতে এই ৮ জনকে দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পশ্চিম-উত্তর কোনে এনে জোরপূর্বক কবর খোঁড়ায়। এরপর তাদের হাত পা বেঁধে কবরে নামিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে মাটি চাপা দেয়। প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের জন্য প্রাণদান করে এই ৮জনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম তরফদার শহীদ স্বীকৃতি পেলেও বাকিরা এখনও পায়নি। এসব পরিবারের সদস্যরা তাঁদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) গণকবরের সামনে মানববন্ধন করে। মামনববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, শহীদ পরিবারের সদস্য সদর উপজেলা পরিষদের ভাইচ চেয়ারম্যান ইসমোত আরা, হোসনে আরা, আয়েশা বেগম, আব্দুর রহিম, ফরিদ তরফদার, সামসুন্নাহার প্রমুখ। এই শহীদ পরিবার আকুতি জানিয়েছেন দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী মানুষগুলোকে শহীদ স্বীকৃতি হিসেবে দেখে মরতে চান।

এ মানববন্ধন শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব সালমা সেলিম এবং জেলা প্রশাসক আনজুমান আরার কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহীদ স্বিকৃতির জন্য তাঁদের পরিবারে কয়েকটি পজন্ম নানা দপ্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- কিন্তু মেলেনি স্বিকৃতি। এই সময়ের মধ্যে শহীদদের বাবা, ভাই, স্ত্রী, তাদের সন্তান বাবা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেক শহীদের বাবা-মা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তান মারা গিয়েছেন। বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে তারা এখন ক্লান্ত। চেষ্টা করছেন একই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা।

উল্লেখ্য,এ গনকবরটির পাশেই ১০ ডিসেম্বর তুমুল সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং নড়াইল জেলা শক্র মুক্ত হয়। যাদের রক্তের ওপর দিয়েই ওঠে স্বাধীন দেশের পতাকা, ওই গণকবরের পাশে সহযোদ্ধারা ওড়ান স্বাধীন বাংলার পতাকা। নড়াইলবাসী বর্তমানে এ গণকবরে বিভিন্ন জাতীয় দিবসসহ নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুস্পমাল্য অর্পনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসলেও তারাই এখনও শহীদ স্বীকৃতি পায়নি।

এ গণকবরে চির শায়িত আতিয়ার তরফদারের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, একইসাথে প্রাণদান করলেও শুধু একজনকে শহীদ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাকি সাত বীরকে কেন শহীদের স্বীকৃতি আজও দেয়া হলো না তা বোধগম্য নয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন উৎসর্গকারী বাকি সাতজনকে শহীদের মর্যাদা না দেওয়াটা অপমানেরই শামিল।

শহীদ কাইজার রহমানের স্ত্রী হোসনে আরা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলেন, একজন শহীদ স্ত্রী হিসেবে মরতে চাই। গত ৪৮ বছর ধরে কেঁদে চলেছি। কোনো অনুকম্পায় নয়, আমি আমার বীর স্বামীর জীবন দানের স্বিকৃতি চাই। আমার পরিবার; যে একটি শহীদ পরিবার সেই রাষ্ট্রীয় স্বিকৃতি চাই।

মুক্তিযুদ্ধকালীন নড়াইল মহকুমা গেরিলা বেইজ ও ডেমুলেশন কমান্ডার অ্যান্ড পলিটিক্যাল মোটিভেটর অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান জিন্নাহ বলেন, তারা অবশ্যই স্বীকৃতি পাবার যোগ্য। কারণ তারা যুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে , মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা করেছে এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মুভমেন্ট করেছে।

যাছাই-বাছাই কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এমএম আবু সাইদ রানা বলেন, গণকবরে শায়িত যেসব শহীদ এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি তাদের তালিকা এবার বিশেষভাবে জামুকায় পাঠানো হবে।