পাক সেনাদের গণহত্যার বিচারের আওতায় আনা ন্যায় বিচারের দাবী

217
71

সৈয়দ আনোয়ারুল হক

পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যার যে বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাত্রিতে বাংলাদেশে সংগঠিত পাক সেনাদের গণহত্যা তাদের মধ্যে অন্যতম।

ইংরেজীতে হত্যাযজ্ঞ বর্ণনায় ব্যবহৃত শব্দটি হল Holocaust- যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুখ্যাত জার্মানীর নাৎসী বাহিনী সংগঠিত করেছিল নৃশংসভাবে ইহুদী জাতিকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। Holocaust শব্দটি মূলত জাতিগত নিধনকেই নির্দেশ করে যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী মুসলমানদের সমান অধিকার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী দিতে চায়নি কখনো। বাঙ্গালীরা বীরোচিত ও সাহস নয়- এমন ধারনা তারা পোষণ করত। কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারতীয় আক্রমণ থেকে লাহোর শহরকে রক্ষা করেছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাহসী বাঙ্গালী যোদ্ধারা। বাংলাদেশ বিসিএস পরীক্ষার মত পাকিস্তানের সিএসএস পরীক্ষায় বাঙ্গালী পরীক্ষার্থীরাই ভালো ফলাফল অর্জন করত। তা সত্ত্বেও চাকুরীতে বাঙ্গালীরা চরম বৈষম্যের শিকার হত। সেনাবাহিনীতে উচ্চ পর্যায়ে বাঙ্গালীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য।

১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ Landslide Victory- ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করায় বাঙ্গালী জাতি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের মিলিটারি শাসকরা তা মানতে পারেনি। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টোর চক্রান্তে ইয়াহিয়া খান সৈন্য সমাবেশ শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধু সঙ্গে আলোচনার অজুহাতে সময় নিয়ে গণহত্যার নীল নকশা চূড়ান্ত করে।

মার্চে প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ঢাকায়। কিন্তু তা হঠাৎ স্থগিত করায় বাঙ্গালী ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং এসব কর্মকাণ্ডের অগ্রদূত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী। দেশের রাজনীতির ব্যাপারে আমরা সবাই ছিলাম সচেতন। আমার ক্ষেত্রে এই সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৬৯ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আমার সম্পৃক্ততার কারণে। তখন সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা কেন্দ্র থেকে সংবাদ বুলেটিন প্রচারিত হত পাঁচ মিনিটের। মার্চে রাজনীতির অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে সকাল-সন্ধ্যায় দু’টি বুলেটিন প্রচারিত হতে থাকে দশ মিনিটের। ২৩শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় বুলেটিন পড়ে যখন শাহবাগের রেডিও স্টেশন থেকে বের হলাম, গেটে সশস্ত্র পাক সেনাদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখলাম।

আমার পরবর্তী বুলেটিন ছিল ২৬শে মার্চ সকাল ৭টায়। তৎকালীন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম আমি, কিন্তু সংঘাতের আশঙ্কায় পারিবারিক চাপে তখন বাসাবো এলাকায় এক ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করছি। নানা ধরনের উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ২৫শে মার্চ দিনটি পার হল। রাজারবাগ পুলিশ লাইন বাসাবোর কাছেই অবস্থিত। মধ্যরাতে মুহুর্মুহু গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ আর মানুষের চিৎকার শুনে আতঙ্কিত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রাজারবাগ এলাকায় দেখলাম আগুনের স্ফুলিঙ্গ। সারা রাত ধরেই প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পেলাম। ভোরে নীচে নেমে রাস্তায় দেখি আতঙ্কিত মানুষের ঢল- সবাই ছুটছে গ্রামের দিকে। আমরাও ঢাকায় থাকা নিরাপদ না ভেবে দ্রুতই চললাম ঘোড়াশালের উদ্দেশ্যে।

দু’একদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে গণহত্যার খবর প্রচারিত হয়। বিবিসি এ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ক্রমে জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, তৎকালীন ইকবাল হল, তৎকালীন ইপিআর হেডকোয়ার্টার পীলখানা, পুলিশের ব্যারাক রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র পাক সেনারা গণহত্যা চালিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে দেরীতে হলেও পাক সেনাদেরও অনুরূপ বিচারের আওতায় আনা ন্যায় বিচারের দাবী।

২৫শে মার্চ গণহত্যা দিবস ২০১৮ উপলক্ষে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি) আয়োজিত স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভায় এই ভয়াল স্মৃতি তর্পণ করেন উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টস এন্ড হিউম্যানিটিস এর ডীন মহোদয় ও ইংরেজী বিভাগের প্রফেসর সৈয়দ আনোয়ারুল হক। গণহত্যা দিবসের স্মৃতিচারণে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ও ডিআইজি (অব:) বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মো: সফিকুল্লাহ। সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর মো: এনায়েত হোসেন মিয়া ও অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রফেসর মো: আবু সালেহ, উপাচার্য, বিইউবিটি। অনুষ্ঠানের আহবায়ক ছিলেন প্রফেসর মিঞা লুৎফার রহমান, প্রক্টর বিইউবিটি। এছাড়া গণহত্যা দিবসে স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন বিইউবিটি’র শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীসকল।

পরিশেষ- এমএসএ